ঢাকা , রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাবা-মেয়ের লুটপাটের শিকার সোনালী লাইফের ভবিষ্যৎ কী?

  • ডেসটিনি রিপোর্ট
  • আপডেট সময় ০৯:২৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ৮৩ বার পড়া হয়েছে

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাল চুক্তিনামা তৈরি করে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। দুই মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া ও তাসনিয়া কামরুন অনিকা, ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান, ছেলের স্ত্রী শাফিয়া সোবহান চৌধুরী, মেয়েজামাই মীর রাশেদ বিন আমান, নিকটাত্মীয় নূর-ই-হাফজা এবং নিজ স্ত্রী ফজলুতুননেসাকেও এ অর্থ লুটপাটে ব্যবহার করেছেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস।

অর্থ লোপাটের অভিযোগে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে সোনালী লাইফের কর্তৃত্ব ফিরে পেতে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের অনুসারীরা আইডিআরএ ও প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। এমনকি আইডিআরএর সাবেক চেয়ারম্যানকে তার কার্যালয়ে দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধও করে রাখেন। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে সম্প্রতি সোনালী লাইফে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে অন্তর্বর্তী বোর্ড গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

সোনালী লাইফের অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠনের নির্দেশ

আইডিআরএর সাবেক সদস্য মইনুল ইসলাম ও সাবেক গ্রেড-১ কর্মকর্তা মো. জাফর ইকবালকে স্বতন্ত্র পরিচালক করার পাশাপাশি মইনুল ইসলামকে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ করে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন করতে বলা হয়েছে।

এরপর থেকেই গুঞ্জন উঠেছে, অনিয়মের দায়ে সোনালী লাইফের যে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তারাই আবার কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের অনুসারীরা আবারও সোনালী লাইফের পর্ষদে ফিরে আসছেন। তবে সোনালী লাইফের অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া মইনুল ইসলাম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে নির্দেশনা দিয়েছে তাতে অন্তর্বর্তী বোর্ড গঠনে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

যা বলছেন অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যান

অন্তর্বর্তী বোর্ড কীভাবে গঠন করা হবে জানতে চাইলে মইনুল ইসলাম  বলেন, ‘আমাদের আইন-কানুন, বিধি-বিধান দেখে অন্তর্বর্তী বোর্ড গঠন করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও আইডিআরএ উভয় বলেছে বিধি-বিধান দেখে। তবে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। এগুলো অনুসরণ করেই আমাদের কাজটা করতে হবে।’

বাইরে গুঞ্জন রয়েছে অনিয়মের অভিযোগে যাদের কোম্পানি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল তারাই পর্ষদে ফিরে আসতে পারেন। এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত এখনো কিছু হয়নি। সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’

যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, তারাও কি পর্ষদে ফিরে আসার সুযোগ পাবে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এগুলো তো আমাদের দেখতে হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আইডিআরএ আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তারা তো আমাদের এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়নি। এগুলো তো বলতে হবে। তারা তো কিছু বলেনি।’

তাহলে কি অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন করা আপনাদের জন্য জটিল হয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন করা হলে মইনুল ইসলাম বলেন, ‘হ্যাঁ জটিল হতে পারে।’

যোগাযোগ করা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে কোনো পর্ষদ গঠন হবে না। বিধি মোতাবেক যেভাবে হয়, তারাই করবে। তবে ওখানে (সোনালী লাইফ) যাতে অনিয়ম না হয়, আইন-সিস্টেম মতো চলে সেজন্য আমরা একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। উনি সব সময় থাকবেন। কোম্পানি নিয়মমাফিক চলছে কি না তা সরকারকে জানাবেন।’

যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তারাই যদি পর্ষদে ফিরে আসে বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করবে কি না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সোনালী লাইফে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। আইডিআরএ আমাদের কাছে অনুরোধ করেছিল জটিলতা নিরসন করার জন্য। আমরা দুই পক্ষের মতামত নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি গাইডলাইন দিয়েছি। কোনো কিছু নিয়মমাফিক না হলে পর্যবেক্ষক আমাদের জানাবে। আমরা চাই কোম্পানিটি আইন অনুযায়ী চলুক।’

দুদকের অনুসন্ধানে যা মিলেছে

এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, মোস্তফা কামরুস সোবহান, শাফিয়া সোবহান চৌধুরী, তাসনিয়া কামরুন অনিকা, ফজলুতুননেসা, নূর-ই-হাফজা এবং মীর রাশেদ বিন আমান সুপরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বিধিবর্হিভূতভাবে একই পরিবারের সাতজন সদস্য সোনালী লাইফের বোর্ড পরিচালক এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ গ্রহণ করেন।

একই সঙ্গে একে অপরের সহায়তায় প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে জাল চুক্তিনামা তৈরি করে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা উত্তোলন করে, পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে এই অর্থ তাদের নামের বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে।

এর মাধ্যমে তারা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ও (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এ বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াত সম্প্রতি এজাহার দায়ের করেন।

দুদকের এজাহারে যা আছে

এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সোনালী লাইফের পেইড আপ ক্যাপিটাল বৃদ্ধির জন্য ২০১৮ সালে উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে ১ কোটি ৫ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার (প্রতিটি ১০ টাকা) ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোম্পানির পরিচালক ও প্রথম চেয়ারম্যান আসামি নূর-ই-হাফজা, পরিচালক ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস এ কোম্পানিরও চেয়ারম্যান), পরিচালক শাফিয়া সোবহান চৌধুরী ও শেখ মোহাম্মদ ডানিয়েলের (মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের জামাতা) কাছ থেকে কোনো টাকা গ্রহণ না করেই তাদের নামে ৯ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার ইস্যু করা হয়।

পরবর্তীসময়ে সোনালী লাইফের এফডিআরের বিপরীতে সাউথ বাংলা ব্যাংকে (এসওডি হিসাব নম্বর- ০০০২৬২২০০০০৭৩) হিসাব খুলে ঋণ হিসেবে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা উত্তোলন এবং ব্যাংকে কোম্পানির সঞ্চয়ী হিসাব (নম্বর-০০০২১৩০০০০৩৩৪) থেকে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকাসহ মোট ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে আসামিরা একই ব্যাংকে কোম্পানির হিসাবে (নম্বর ০০০২৬২২০০০০৭৩) জমা করে, যা এই পরিচালকদের শেয়ার কেনার মূল্য হিসেবে প্রদর্শন করেন।

প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোস্তফা গোলাম কুদ্দস তার ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান ও মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার কাছ থেকে ২৬ লাখ ৮০টি শেয়ার বিনামূল্যে লাভ করে পরিচালক হন। পরবর্তীসময়ে মোস্তফা কামরুস সোবহান তার স্ত্রী শাফিয়া সোবহান চৌধুরীর কাছ থেকে ৩ লাখ শেয়ার, তাসনিয়া কামরুন অনিকা তার স্বামী শেখ মোহম্মদ ড্যানিয়েলের কাছ থেকে ১২ লাখ শেয়ার এবং আসামি ফজলুতুননেসা রূপালী ইন্স্যুরেন্স থেকে ৬ লাখ ২৫ হাজার শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে লাভ করেন।

এছাড়া মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ১৪ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার তার মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়াকে ও ২ লাখ ৩০ শেয়ার তার স্ত্রী ফজলুতুননেসাকে এবং শাফিয়া সোবহান চৌধুরী ও তার স্বামী মোস্তফা কামরুস সোবহানকে ৬ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার হস্তান্তর করেন। এভাবে অবৈধভাবে প্রয়োজনীয় শেয়ার ধারণের মাধ্যমে বিধি বহির্ভূতভাবে একই পরিবারের সাতজন সদস্য কোম্পানির বোর্ডে পরিচালক হয়ে পারিবারিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের অন্য জামাতা মীর রাশেদ বিন আমানকে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ দিয়ে বর্ণিত অর্থ আত্মসাৎ করা হয় বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস সুপরিকল্পিতভাবে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩ কোটি টাকা হিসাবে মোট ১৮ কোটি টাকা কোম্পানির জনতা ব্যাংক (রামপুরা শাখার হিসাব নম্বর-০১০০০১৫২৫১৯৮) থেকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটারের জনতা ব্যাংক হিসাবে (মতিঝিল করপোরেট শাখার হিসাব নম্বর-০১০০০০ ১০০৯৯৫২) বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে স্থানান্তর করেন।

এছাড়া বোর্ড সভার কার্যবিবরণীর জাল উদ্ধৃতাংশ দাখিল করে কোম্পানির এফডিআরের বিপরীতে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক থেকে মোট ১৯৫ কোটি ৪২ লাখ ৮১ হাজার ২০০ টাকা ঋণ গ্রহণ এবং তার মধ্যে ৮৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা কোম্পানির বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তরের পর মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করে আত্মসাৎ করেন।

এক্ষেত্রে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস চেয়ারম্যান থাকাকালীন অসৎ উদ্দেশ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয়ে অবৈধভাবে তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ড্রাগন ইনফরমেশন টেকনোলজি ও কমিউনিকেশন লি., ড্রাগন সোয়েটার লি., ইম্পেরিয়াল সোয়েটার লিমিটেড এবং ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিং লিমিটেডের বিভিন্ন সময়ে মোট ১৪১ কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা স্থানান্তর করে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন।

দুদকের রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি মাসে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ২ লাখ, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া ২ লাখ, তাসনিয়া কামরুন অনিকা ২ লাখ, মোস্তফা কামরুস সোবহান ৩ লাখ, শাফিয়া সোবহান চৌধুরী ১ লাখ, ফজলুতুননেসা ২ লাখ, শেখ মোহাম্মদ ডানিয়েল ২ লাখ এবং নূর-ই-হাফজা ২ লাখ টাকা করে আটজন পরিচালক অবৈধভাবে বেতন হিসেবে দেখিয়ে নগদ উত্তোলন করে তাদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেন মোট ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

এভাবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, মোস্তফা কামরুস সোবহান, শাফিয়া সোবহান চৌধুরী, তাসনিয়া কামরুন অনিকা, ফজলুতুননেসা, নূর-ই-হাফজা এবং মীর রাশেদ বিন আমান সুপরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে বিধিবর্হিভূতভাবে একই পরিবারের সাতজন সদস্য সোনালী লাইফের বোর্ডে পরিচালক এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদ গ্রহণ করে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে কোম্পানিটির তহবিল থেকে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা যেভাবে আত্মসাৎ করা হয়

>> কোম্পানির টাকায় নিজেদের জন্য শেয়ার ইস্যু বাবদ ৯ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

>> জমি/ভবন কেনার অগ্রিম দেখিয়ে গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে প্রদান ১৪১ কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা।

>> নিজ পরিবারের সদস্য পরিচালকদের অবৈধ মাসিক বেতন বাবদ ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

>> নিজ প্রতিষ্ঠানকে সোয়েটার কেনা, আপ্যায়ন, ইআরপি মেইনটেন্যান্স বাবদ ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৭ টাকা।

>> অবৈধভাবে বিলাসবহুল অডি কার কেনা বাবদ ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

>> নিজ পরিবারের সদস্য পরিচালকদের অতিরিক্ত ডিভিডেন্ড দেওয়া বাবদ ১ কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার ৭৫০ টাকা।

>> বিদেশে নিজের চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, ভ্রমণব্যয় বাবদ ১ কোটি ৫৪ লাখ ৯০ হাজার ৮০০ টাকা।

>> গ্রুপ বিমা পলিসি থেকে অবৈধ কমিশন বাবদ ৯ লাখ টাকা।

>> ঋণ সমন্বয়, অনুদান, ব্যক্তিগত এসি কেনা, কোরবানির গরু কেনা, বিদেশ ভ্রমণ, পলিসি নবায়ন উপহার, আইপিও খরচের নামে অবৈধ ব্যয় বাবদ ৮ কোটি ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫৯ টাকা।

>> অফিস ভাড়ার নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ড্রাগন আইটিকে প্রদান ১১ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ১৭ টাকা।

>> নিজ মালিকানাধীন পুরো ভবনের ইউটিলিটি বিল পরিশোধ বাবদ ১ কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার ২২৩ টাকা।

>> নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিংয়েল ট্যাক্স পরিশোধ বাবদ ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

আত্মসাৎ করা টাকা অফিস ভাড়া হিসেবে চুক্তিনামা দাখিল

এই ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি তদন্তে উদঘাটিত হওয়ার পর মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস এই টাকা অফিস ভাড়া হিসেবে গ্রহণের পক্ষে ভাড়ার চুক্তিনামা প্রস্তুত করে দাখিল করেন। চুক্তিপত্রে ভবন মালিক হিসেবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও কোম্পানির পক্ষে তার মেয়ের জামাতা শেখ মোহাম্মদ ডানিয়েল সই করেন। কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বা চেয়ারম্যান এতে সই করেননি। ২০১৩ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বছরভিত্তিক ফ্লোর এরিয়ার অবাস্তব চাহিদা নির্ধারণ করে ১৮৪ কোটি ৫২ লাখ ২২ হাজার ৮০০ টাকার ভাড়া চুক্তি ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর সই করা হয়েছে।

জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে অবাস্তব চাহিদা নির্ধারণ করে একটি কথিত চুক্তিনামা তৈরি করা হয় বলে মনে কর দুদক। কারণ এই চুক্তিনামা ১০০ টাকার যে চারটি নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি সই করা হয়েছে, সেগুলোর সং-খব-৬৮২০৯৩০, খব- ৬৮২০৯৩১, খব-৬৮২০৯৩২ ও খব- ৬৮২০৯৩৩। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সহকারী নিয়ন্ত্রকের (স্ট্যাম্পস) ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল স্মারক নং- ১৪.০০০০. ০৪৭.১৬.০০১.২২/১৮৩ অনুযায়ী এই চারটি স্ট্যাম্প সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর ডাক বিভাগ গ্রহণ করে এবং পরের দিন ১৭ নভেম্বর জেলা ট্রেজারি, নরসিংদীতে সরবরাহ করে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কল ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

বাবা-মেয়ের লুটপাটের শিকার সোনালী লাইফের ভবিষ্যৎ কী?

আপডেট সময় ০৯:২৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাল চুক্তিনামা তৈরি করে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। দুই মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া ও তাসনিয়া কামরুন অনিকা, ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান, ছেলের স্ত্রী শাফিয়া সোবহান চৌধুরী, মেয়েজামাই মীর রাশেদ বিন আমান, নিকটাত্মীয় নূর-ই-হাফজা এবং নিজ স্ত্রী ফজলুতুননেসাকেও এ অর্থ লুটপাটে ব্যবহার করেছেন মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস।

অর্থ লোপাটের অভিযোগে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তবে সোনালী লাইফের কর্তৃত্ব ফিরে পেতে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের অনুসারীরা আইডিআরএ ও প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। এমনকি আইডিআরএর সাবেক চেয়ারম্যানকে তার কার্যালয়ে দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধও করে রাখেন। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠলে সম্প্রতি সোনালী লাইফে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়ে অন্তর্বর্তী বোর্ড গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

সোনালী লাইফের অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠনের নির্দেশ

আইডিআরএর সাবেক সদস্য মইনুল ইসলাম ও সাবেক গ্রেড-১ কর্মকর্তা মো. জাফর ইকবালকে স্বতন্ত্র পরিচালক করার পাশাপাশি মইনুল ইসলামকে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ করে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন করতে বলা হয়েছে।

এরপর থেকেই গুঞ্জন উঠেছে, অনিয়মের দায়ে সোনালী লাইফের যে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তারাই আবার কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের অনুসারীরা আবারও সোনালী লাইফের পর্ষদে ফিরে আসছেন। তবে সোনালী লাইফের অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া মইনুল ইসলাম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে নির্দেশনা দিয়েছে তাতে অন্তর্বর্তী বোর্ড গঠনে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

যা বলছেন অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যান

অন্তর্বর্তী বোর্ড কীভাবে গঠন করা হবে জানতে চাইলে মইনুল ইসলাম  বলেন, ‘আমাদের আইন-কানুন, বিধি-বিধান দেখে অন্তর্বর্তী বোর্ড গঠন করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও আইডিআরএ উভয় বলেছে বিধি-বিধান দেখে। তবে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। এগুলো অনুসরণ করেই আমাদের কাজটা করতে হবে।’

বাইরে গুঞ্জন রয়েছে অনিয়মের অভিযোগে যাদের কোম্পানি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল তারাই পর্ষদে ফিরে আসতে পারেন। এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত এখনো কিছু হয়নি। সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’

যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, তারাও কি পর্ষদে ফিরে আসার সুযোগ পাবে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এগুলো তো আমাদের দেখতে হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আইডিআরএ আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তারা তো আমাদের এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়নি। এগুলো তো বলতে হবে। তারা তো কিছু বলেনি।’

তাহলে কি অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন করা আপনাদের জন্য জটিল হয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন করা হলে মইনুল ইসলাম বলেন, ‘হ্যাঁ জটিল হতে পারে।’

যোগাযোগ করা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে কোনো পর্ষদ গঠন হবে না। বিধি মোতাবেক যেভাবে হয়, তারাই করবে। তবে ওখানে (সোনালী লাইফ) যাতে অনিয়ম না হয়, আইন-সিস্টেম মতো চলে সেজন্য আমরা একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছি। উনি সব সময় থাকবেন। কোম্পানি নিয়মমাফিক চলছে কি না তা সরকারকে জানাবেন।’

যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তারাই যদি পর্ষদে ফিরে আসে বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করবে কি না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সোনালী লাইফে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। আইডিআরএ আমাদের কাছে অনুরোধ করেছিল জটিলতা নিরসন করার জন্য। আমরা দুই পক্ষের মতামত নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি গাইডলাইন দিয়েছি। কোনো কিছু নিয়মমাফিক না হলে পর্যবেক্ষক আমাদের জানাবে। আমরা চাই কোম্পানিটি আইন অনুযায়ী চলুক।’

দুদকের অনুসন্ধানে যা মিলেছে

এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, মোস্তফা কামরুস সোবহান, শাফিয়া সোবহান চৌধুরী, তাসনিয়া কামরুন অনিকা, ফজলুতুননেসা, নূর-ই-হাফজা এবং মীর রাশেদ বিন আমান সুপরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য বিধিবর্হিভূতভাবে একই পরিবারের সাতজন সদস্য সোনালী লাইফের বোর্ড পরিচালক এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ গ্রহণ করেন।

একই সঙ্গে একে অপরের সহায়তায় প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে জাল চুক্তিনামা তৈরি করে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে সোনালী লাইফের তহবিল থেকে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা উত্তোলন করে, পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে এই অর্থ তাদের নামের বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে।

এর মাধ্যমে তারা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ও (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এ বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াত সম্প্রতি এজাহার দায়ের করেন।

দুদকের এজাহারে যা আছে

এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সোনালী লাইফের পেইড আপ ক্যাপিটাল বৃদ্ধির জন্য ২০১৮ সালে উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে ১ কোটি ৫ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার (প্রতিটি ১০ টাকা) ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোম্পানির পরিচালক ও প্রথম চেয়ারম্যান আসামি নূর-ই-হাফজা, পরিচালক ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস এ কোম্পানিরও চেয়ারম্যান), পরিচালক শাফিয়া সোবহান চৌধুরী ও শেখ মোহাম্মদ ডানিয়েলের (মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের জামাতা) কাছ থেকে কোনো টাকা গ্রহণ না করেই তাদের নামে ৯ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার ইস্যু করা হয়।

পরবর্তীসময়ে সোনালী লাইফের এফডিআরের বিপরীতে সাউথ বাংলা ব্যাংকে (এসওডি হিসাব নম্বর- ০০০২৬২২০০০০৭৩) হিসাব খুলে ঋণ হিসেবে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা উত্তোলন এবং ব্যাংকে কোম্পানির সঞ্চয়ী হিসাব (নম্বর-০০০২১৩০০০০৩৩৪) থেকে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকাসহ মোট ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করে আসামিরা একই ব্যাংকে কোম্পানির হিসাবে (নম্বর ০০০২৬২২০০০০৭৩) জমা করে, যা এই পরিচালকদের শেয়ার কেনার মূল্য হিসেবে প্রদর্শন করেন।

প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোস্তফা গোলাম কুদ্দস তার ছেলে মোস্তফা কামরুস সোবহান ও মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়ার কাছ থেকে ২৬ লাখ ৮০টি শেয়ার বিনামূল্যে লাভ করে পরিচালক হন। পরবর্তীসময়ে মোস্তফা কামরুস সোবহান তার স্ত্রী শাফিয়া সোবহান চৌধুরীর কাছ থেকে ৩ লাখ শেয়ার, তাসনিয়া কামরুন অনিকা তার স্বামী শেখ মোহম্মদ ড্যানিয়েলের কাছ থেকে ১২ লাখ শেয়ার এবং আসামি ফজলুতুননেসা রূপালী ইন্স্যুরেন্স থেকে ৬ লাখ ২৫ হাজার শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে লাভ করেন।

এছাড়া মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ১৪ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার তার মেয়ে ফৌজিয়া কামরুন তানিয়াকে ও ২ লাখ ৩০ শেয়ার তার স্ত্রী ফজলুতুননেসাকে এবং শাফিয়া সোবহান চৌধুরী ও তার স্বামী মোস্তফা কামরুস সোবহানকে ৬ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার হস্তান্তর করেন। এভাবে অবৈধভাবে প্রয়োজনীয় শেয়ার ধারণের মাধ্যমে বিধি বহির্ভূতভাবে একই পরিবারের সাতজন সদস্য কোম্পানির বোর্ডে পরিচালক হয়ে পারিবারিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের অন্য জামাতা মীর রাশেদ বিন আমানকে কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ দিয়ে বর্ণিত অর্থ আত্মসাৎ করা হয় বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস সুপরিকল্পিতভাবে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩ কোটি টাকা হিসাবে মোট ১৮ কোটি টাকা কোম্পানির জনতা ব্যাংক (রামপুরা শাখার হিসাব নম্বর-০১০০০১৫২৫১৯৮) থেকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটারের জনতা ব্যাংক হিসাবে (মতিঝিল করপোরেট শাখার হিসাব নম্বর-০১০০০০ ১০০৯৯৫২) বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে স্থানান্তর করেন।

এছাড়া বোর্ড সভার কার্যবিবরণীর জাল উদ্ধৃতাংশ দাখিল করে কোম্পানির এফডিআরের বিপরীতে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক থেকে মোট ১৯৫ কোটি ৪২ লাখ ৮১ হাজার ২০০ টাকা ঋণ গ্রহণ এবং তার মধ্যে ৮৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা কোম্পানির বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তরের পর মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করে আত্মসাৎ করেন।

এক্ষেত্রে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস চেয়ারম্যান থাকাকালীন অসৎ উদ্দেশ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয়ে অবৈধভাবে তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ড্রাগন ইনফরমেশন টেকনোলজি ও কমিউনিকেশন লি., ড্রাগন সোয়েটার লি., ইম্পেরিয়াল সোয়েটার লিমিটেড এবং ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিং লিমিটেডের বিভিন্ন সময়ে মোট ১৪১ কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা স্থানান্তর করে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন।

দুদকের রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি মাসে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ২ লাখ, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া ২ লাখ, তাসনিয়া কামরুন অনিকা ২ লাখ, মোস্তফা কামরুস সোবহান ৩ লাখ, শাফিয়া সোবহান চৌধুরী ১ লাখ, ফজলুতুননেসা ২ লাখ, শেখ মোহাম্মদ ডানিয়েল ২ লাখ এবং নূর-ই-হাফজা ২ লাখ টাকা করে আটজন পরিচালক অবৈধভাবে বেতন হিসেবে দেখিয়ে নগদ উত্তোলন করে তাদের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেন মোট ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

এভাবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, ফৌজিয়া কামরুন তানিয়া, মোস্তফা কামরুস সোবহান, শাফিয়া সোবহান চৌধুরী, তাসনিয়া কামরুন অনিকা, ফজলুতুননেসা, নূর-ই-হাফজা এবং মীর রাশেদ বিন আমান সুপরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে বিধিবর্হিভূতভাবে একই পরিবারের সাতজন সদস্য সোনালী লাইফের বোর্ডে পরিচালক এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদ গ্রহণ করে বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে কোম্পানিটির তহবিল থেকে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা যেভাবে আত্মসাৎ করা হয়

>> কোম্পানির টাকায় নিজেদের জন্য শেয়ার ইস্যু বাবদ ৯ কোটি ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

>> জমি/ভবন কেনার অগ্রিম দেখিয়ে গোলাম কুদ্দুসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে প্রদান ১৪১ কোটি ৫৬ লাখ ৯০ হাজার ৫০০ টাকা।

>> নিজ পরিবারের সদস্য পরিচালকদের অবৈধ মাসিক বেতন বাবদ ২ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

>> নিজ প্রতিষ্ঠানকে সোয়েটার কেনা, আপ্যায়ন, ইআরপি মেইনটেন্যান্স বাবদ ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৭ টাকা।

>> অবৈধভাবে বিলাসবহুল অডি কার কেনা বাবদ ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

>> নিজ পরিবারের সদস্য পরিচালকদের অতিরিক্ত ডিভিডেন্ড দেওয়া বাবদ ১ কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার ৭৫০ টাকা।

>> বিদেশে নিজের চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, ভ্রমণব্যয় বাবদ ১ কোটি ৫৪ লাখ ৯০ হাজার ৮০০ টাকা।

>> গ্রুপ বিমা পলিসি থেকে অবৈধ কমিশন বাবদ ৯ লাখ টাকা।

>> ঋণ সমন্বয়, অনুদান, ব্যক্তিগত এসি কেনা, কোরবানির গরু কেনা, বিদেশ ভ্রমণ, পলিসি নবায়ন উপহার, আইপিও খরচের নামে অবৈধ ব্যয় বাবদ ৮ কোটি ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫৯ টাকা।

>> অফিস ভাড়ার নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ড্রাগন আইটিকে প্রদান ১১ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ১৭ টাকা।

>> নিজ মালিকানাধীন পুরো ভবনের ইউটিলিটি বিল পরিশোধ বাবদ ১ কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার ২২৩ টাকা।

>> নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিংয়েল ট্যাক্স পরিশোধ বাবদ ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

আত্মসাৎ করা টাকা অফিস ভাড়া হিসেবে চুক্তিনামা দাখিল

এই ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি তদন্তে উদঘাটিত হওয়ার পর মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস এই টাকা অফিস ভাড়া হিসেবে গ্রহণের পক্ষে ভাড়ার চুক্তিনামা প্রস্তুত করে দাখিল করেন। চুক্তিপত্রে ভবন মালিক হিসেবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস ও কোম্পানির পক্ষে তার মেয়ের জামাতা শেখ মোহাম্মদ ডানিয়েল সই করেন। কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বা চেয়ারম্যান এতে সই করেননি। ২০১৩ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত বছরভিত্তিক ফ্লোর এরিয়ার অবাস্তব চাহিদা নির্ধারণ করে ১৮৪ কোটি ৫২ লাখ ২২ হাজার ৮০০ টাকার ভাড়া চুক্তি ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর সই করা হয়েছে।

জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে অবাস্তব চাহিদা নির্ধারণ করে একটি কথিত চুক্তিনামা তৈরি করা হয় বলে মনে কর দুদক। কারণ এই চুক্তিনামা ১০০ টাকার যে চারটি নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি সই করা হয়েছে, সেগুলোর সং-খব-৬৮২০৯৩০, খব- ৬৮২০৯৩১, খব-৬৮২০৯৩২ ও খব- ৬৮২০৯৩৩। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সহকারী নিয়ন্ত্রকের (স্ট্যাম্পস) ২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল স্মারক নং- ১৪.০০০০. ০৪৭.১৬.০০১.২২/১৮৩ অনুযায়ী এই চারটি স্ট্যাম্প সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর ডাক বিভাগ গ্রহণ করে এবং পরের দিন ১৭ নভেম্বর জেলা ট্রেজারি, নরসিংদীতে সরবরাহ করে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কল ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।