ঢাকা , বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বারবার দীর্ঘ হচ্ছে ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীর প্রতীক্ষা

লাখো গ্রাহকের স্বপ্ন ধূলিসাৎ সমাধান ন্যায়বিচারে

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট সময় ১০:৪৩:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৫৫৮ বার পড়া হয়েছে

আগামী ১৫ জানুয়ারি ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের (ডিটিপিএল) গাছ বিক্রির টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলার রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।

এর আগে গত ২৮ নভেম্বর রায় ঘোষণার কথা থাকলেও তা প্রস্তত হয়নি জানিয়ে নতুন দিন ধার্য করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক মো. রবিউল আলম।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে কলাবাগান থানায় বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তখন থেকেই কারান্তরীণ রয়েছেন রফিকুল আমীন। টানা এক যুগেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়ে ফেলেছেন তিনি। এত দীর্ঘ সময়েও মামলা, সাজা ও কারাবাসের পরেও এখনো ডেসটিনি বা ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে সুরাহা হয়নি। ডেসটিনি-সংক্রান্ত দুই আলোচিত মামলার একটিরও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এতে দিন দিন হতাশা আর ক্ষোভ বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। দুদক তাদের সুরক্ষার কথা বলেও মামলা করলেও তাদের কোনো সাক্ষ্য নেয়নি। ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীর কেউ কখনো ডেসটিনির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও করেনি। তারপরেও কার ইশারায় এসব মামলা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল ইসলাম নামের একজন বিনিয়োগকারী।

তিনি বলেন, ‘এটা একটা পরিকল্পিতভাবে করা ষড়যন্ত্র ও প্রতারণামূলক মামলা। কিছু উড়ো চিঠির ভিত্তিতে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীদের রুটি রুজি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের মধ্যে একজন বিনিয়োগকারীও কখনো কোনো অভিযোগ করেনি।

এ ষড়যন্ত্রে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।’ ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন রফিকুল আমীন। অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে করা একটি মামলায় দুই বছরের বেশি সময় আগে ১২ বছরের কারাদণ্ডের হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা না দেওয়ায় একটি মামলায় তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। দুই মামলাতেই তার সাজা খাটা শেষ হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। আর ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ ও পাচারের একটি মামলার রায় হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ১৫ জানুয়ারি।

যে আইনি প্রক্রিয়ায় মিলতে পারে রফিকুল আমীনের মুক্তি
রফিকুল আমীন ও দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছেন বা করছেন এমন বেশ কয়েকজন আইনজীবীর ভাষ্য, রফিকুল আমীনের জামিন কিংবা কারামুক্তি নির্ভর করছে আইনি সমাধানের ও ভুক্তভোগীদের প্রতিকারে কী ব্যবস্থাপনা নেওয়া হবে, তার ওপর। তার বিরুদ্ধে ট্রি প্ল্যান্টেশনের মামলায় মানি লন্ডারিং আইনের চার ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, যাতে সর্বো”চ সাজা ১২ বছর এবং পাচারকৃত অর্থের দ্বিগুণ অর্থদণ্ড ও তা অনাদায়ে কারাবাস।

ডিটিপিএলের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় রফিকুল আমীনের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘যদি ট্রি প্ল্যান্টেশন মামলায় সর্বো”চ শাস্তিও (১২ বছরের কারাদণ্ড) হয়, তাহলেও সংশ্লিষ্ট আইনের ৩৫(এ)  ধারা অনুযায়ী তিনি সুবিধা পাওয়ার অধিকারী।’ তিনি বলেন, অর্থদণ্ডের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫(বি) ধারার অর্থ হচ্ছে, আদালত সাজা সমন্বয় করে মুক্তির আদেশ দিতে পারে। যদি সেটা না হয়, সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে যখন আপিল ফাইল হবে, তখন অর্থদণ্ড স্থগিত হলে তার মুক্তিতে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না।’

এদিকে তার এই আইনি বিশ্লেষণে ভিন্নমত পোষণ না করলেও রফিকুল আমীনের জামিন ও কারামুক্তিতে আদালতের সিদ্ধান্তসহ আরও কিছু বিষয়ের সুরাহা প্রয়োজন বলে মনে করেন দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।

বিনিয়োগকারীদের হতাশা ও ক্ষোভ চরমে
অন্যদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা জমেছে ডেসটিনির ত্রেতা ও পরিবেশকদের মধ্যে। কারণ এ দীর্ঘ সময়ে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার কথা বলে দুদক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের সর্বনাশ করেছে অভিযোগ করেন তারা। তারপরও দুদকের মনগড়া মামলায় রফিকুল আমীনকে এক যুগ ধরে কারাবন্দি করে রাখায়
ভুগতে হচ্ছে তাদের ।

তারা মনে করেন, নতুন করে ডেসটিনির ঘুরে দাঁড়াতে রফিকুল আমীনের কোনো বিকল্প নেই । ক্ষতি যতটা সম্ভব পুষিয়ে নিতেও রফিকুল আমীনকেই প্রয়োজন তাদের।

কুমিল্লা থেকে আগত আরিফ নামের একজন পরিবেশক বলেন, ‘রফিকুল আমিনের কাছেই আমাদের বিনিয়োগ নিরাপদ। তার ওপর আমাদের কোনোদিন কোনো অভিযোগ ছিল না। তার ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। বিচার ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কারের দাবি তুলছেন কেউ কেউ। তবে আদালতের প্রতি এখনো আস্থা রাখতে চান তারা। ১৫ জানুয়ারি তারা সুবিচার পাবেন বলে আশাবাদী অনেকে।

ডিটিপিএল ও ডিএমসিএসএ এর বিরুদ্ধে করা দুটি মামলায় মোট ৪১০০ কোটি টাকা নয় ছয়ের অভিযোগ করে দুদক। এছাড়া ডেসটিনির ‘দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোতে রফিকুল আমীন অর্থ বিনিয়োগ করেছেন’ দাবি করে এটিকে ‘মানি লন্ডারিং’ বলে আখ্যা দিয়েছে দুদক। ডিএমসিএস’র বিরুদ্ধে করা মামলার চার্জশিটে গত ১২ বছরে তিন শতাধিক সাক্ষী আদালতে হাজির করে দুদক।
এদের মধ্যে ছিলেন, বিভিন্ন ব্যাংকের ম্যানেজার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, জয়েট স্টকের কমকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে অবাক করার বিষয়, ৮ লাখ ৫৫ হাজার ৪২৯ জন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একজন ব্যক্তিতেও সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির করেনি দুদক। অথচ মামলা হয়েছে কিনা তাদের স্বার্থ রক্ষায়। ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদানসহ ডেসটিনি মোট ব্যয় করেছিল ৫১০৫ কোটি টাকা।

শুধু তাই নয়, ডিস্ট্রিবিউটরদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য কমিশন বাবদ প্রদান করা হয় ১৪৫৬ কোটি টাকা। ডিস্ট্রিবিউটরদের ডিন সিআইডি নম্বর দিয়ে সার্ভারে খোঁজ করলে সহজেই এর প্রমাণ মিলে যায়। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১৪২ কোটি টাকা, যার প্রমাণ রয়েছে ব্যাংকের এলসিগুলোতে। সরকারি কোষাগারে ট্যাক্স-ভ্যাট বাবদ প্রদান করা হয় ৪১০ কোটি। এ ছাড়া স্থানীয় পণ্য ক্রয়ে ২৮৭ কোটি টাকা। শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ বাবদ ২৪১ কোটি প্রদান করা হয়। ১২ ছরে বেতন ভাতাদি এবং প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হয় ৪৩৭ কোটি টাকা। এছাড়াও আমানতকারীদের সুদ বাবদ ২৬ কোটি, বৃক্ষরোপন ব্যয় খাতে ২২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিভিন্ন সম্পদ ক্রয়, সিএসআর ও সদস্যদের ঋণ প্রদান বাবদ ১৮৮৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। সব মিলিয়ে মোট দাঁড়ায় ৫১০৫ কোটি টাকা। ব্যয় হওয়া এসব অর্থের বিষয়েও কিছুই উল্লেখ করা হয়নি মামলার চার্জশিটে।

অযত্ন-অবহেলায় বৃক্ষ প্রকল্পসহ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত এছাড়াও দুদকের মামলার ফলে ২০১২ সালের পর থেকে ডেসটিনির কোনো প্রকল্পে বা সম্পত্তিতে না কোনো তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ। দুদকের পক্ষ থেকে ডেসটিনির বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির জন্য রিসিভার নিয়োগ করা হলেও নিশ্চিত করা হয়নি রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির ব্যবস্থা। ফলে বছরের পর বছরের ধরে এসব সম্পত্তির যথেষ্ঠ ব্যবহার করে পুলিশ থেকে শুরু করে দুর্বৃত্তরা। এনিয়ে দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোতে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। লাখো গ্রাহকের অর্থে বিনিয়োগ করা এসব সম্পদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে তার সঠিক কোনো উত্তর নেই। সময়োচিত পরিবেশবান্ধব এ বিনিয়োগের এমন বেহাল দশা দেখে আক্ষেপের শেষ নেই ডেসটিনির ক্রেতা ও পরিবেশকদের।

বিনিয়োকারীদের মনে আশার আলো
ডেসটিনির প্রায় সব গ্রাহক মনে করেন, ন্যায়বিচার পেয়ে রফিকুল আমীন মুক্ত হলে খুলে যেতে পারে তাদের সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। তাই কষ্টার্জিত বিনিয়োগের অর্থ ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধছেন ডেসটিনি ক্রেতা ও পরিবেশকরা।

গত ১১ নভেম্বর আদালতের এজলাসে দাঁড়িয়ে রফিকুল আমীন বলেছিলেন, মাননীয় আদালত আপনি কি রায়দিবেন আমি জানিনা, আপনি যেই রায় দেন আমি আমার ডিস্ট্রিবিউটরদের টাকা ফেরত দিব। কারণ আমার বিনিয়োগকারীরা ধৈর্য ধরে জীবন বাজী রেখে আমার জন্য দীর্ঘ ১২ বছর কাজ করেছেন। এই বিনিয়োগকারীগণ আমার পরিবার সদস্য। আমি সকল অর্থ ফেরত দিতে চাই। তাই আমাদের সম্পদ ও ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেওয়ার অনুমতি চাই। আপনি সুযোগ দিলে আমি আগামী ২০২৫ থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করব ইনশাআল্লাহ।

লাখো বিনিয়োগকারীর মনে নতুন করে আস্থার সঞ্চার হয়েছে রফিকুল আমীনের এ কথায়। তাদের বিশ্বাস, সম্ভাবনার বিচারে লাভজনক বহু স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে ডেসটিনির। এসব সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকা। ফলে যে কোনো উপায়েই হোক রফিকুল আমীন পাওনা বুঝিয়ে দেবেন বলে দৃঢ় আস্থার কথা জানালেন তারা।

জনপ্রিয় সংবাদ

বারবার দীর্ঘ হচ্ছে ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীর প্রতীক্ষা

লাখো গ্রাহকের স্বপ্ন ধূলিসাৎ সমাধান ন্যায়বিচারে

আপডেট সময় ১০:৪৩:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

আগামী ১৫ জানুয়ারি ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশন লিমিটেডের (ডিটিপিএল) গাছ বিক্রির টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলার রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত।

এর আগে গত ২৮ নভেম্বর রায় ঘোষণার কথা থাকলেও তা প্রস্তত হয়নি জানিয়ে নতুন দিন ধার্য করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক মো. রবিউল আলম।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে কলাবাগান থানায় বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তখন থেকেই কারান্তরীণ রয়েছেন রফিকুল আমীন। টানা এক যুগেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়ে ফেলেছেন তিনি। এত দীর্ঘ সময়েও মামলা, সাজা ও কারাবাসের পরেও এখনো ডেসটিনি বা ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে সুরাহা হয়নি। ডেসটিনি-সংক্রান্ত দুই আলোচিত মামলার একটিরও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এতে দিন দিন হতাশা আর ক্ষোভ বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। দুদক তাদের সুরক্ষার কথা বলেও মামলা করলেও তাদের কোনো সাক্ষ্য নেয়নি। ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীর কেউ কখনো ডেসটিনির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও করেনি। তারপরেও কার ইশারায় এসব মামলা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল ইসলাম নামের একজন বিনিয়োগকারী।

তিনি বলেন, ‘এটা একটা পরিকল্পিতভাবে করা ষড়যন্ত্র ও প্রতারণামূলক মামলা। কিছু উড়ো চিঠির ভিত্তিতে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ৪৫ লাখ বিনিয়োগকারীদের রুটি রুজি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের মধ্যে একজন বিনিয়োগকারীও কখনো কোনো অভিযোগ করেনি।

এ ষড়যন্ত্রে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।’ ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন রফিকুল আমীন। অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে করা একটি মামলায় দুই বছরের বেশি সময় আগে ১২ বছরের কারাদণ্ডের হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা না দেওয়ায় একটি মামলায় তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। দুই মামলাতেই তার সাজা খাটা শেষ হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। আর ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ ও পাচারের একটি মামলার রায় হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ১৫ জানুয়ারি।

যে আইনি প্রক্রিয়ায় মিলতে পারে রফিকুল আমীনের মুক্তি
রফিকুল আমীন ও দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছেন বা করছেন এমন বেশ কয়েকজন আইনজীবীর ভাষ্য, রফিকুল আমীনের জামিন কিংবা কারামুক্তি নির্ভর করছে আইনি সমাধানের ও ভুক্তভোগীদের প্রতিকারে কী ব্যবস্থাপনা নেওয়া হবে, তার ওপর। তার বিরুদ্ধে ট্রি প্ল্যান্টেশনের মামলায় মানি লন্ডারিং আইনের চার ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, যাতে সর্বো”চ সাজা ১২ বছর এবং পাচারকৃত অর্থের দ্বিগুণ অর্থদণ্ড ও তা অনাদায়ে কারাবাস।

ডিটিপিএলের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় রফিকুল আমীনের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, ‘যদি ট্রি প্ল্যান্টেশন মামলায় সর্বো”চ শাস্তিও (১২ বছরের কারাদণ্ড) হয়, তাহলেও সংশ্লিষ্ট আইনের ৩৫(এ)  ধারা অনুযায়ী তিনি সুবিধা পাওয়ার অধিকারী।’ তিনি বলেন, অর্থদণ্ডের বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫(বি) ধারার অর্থ হচ্ছে, আদালত সাজা সমন্বয় করে মুক্তির আদেশ দিতে পারে। যদি সেটা না হয়, সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে যখন আপিল ফাইল হবে, তখন অর্থদণ্ড স্থগিত হলে তার মুক্তিতে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না।’

এদিকে তার এই আইনি বিশ্লেষণে ভিন্নমত পোষণ না করলেও রফিকুল আমীনের জামিন ও কারামুক্তিতে আদালতের সিদ্ধান্তসহ আরও কিছু বিষয়ের সুরাহা প্রয়োজন বলে মনে করেন দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।

বিনিয়োগকারীদের হতাশা ও ক্ষোভ চরমে
অন্যদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা জমেছে ডেসটিনির ত্রেতা ও পরিবেশকদের মধ্যে। কারণ এ দীর্ঘ সময়ে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার কথা বলে দুদক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের সর্বনাশ করেছে অভিযোগ করেন তারা। তারপরও দুদকের মনগড়া মামলায় রফিকুল আমীনকে এক যুগ ধরে কারাবন্দি করে রাখায়
ভুগতে হচ্ছে তাদের ।

তারা মনে করেন, নতুন করে ডেসটিনির ঘুরে দাঁড়াতে রফিকুল আমীনের কোনো বিকল্প নেই । ক্ষতি যতটা সম্ভব পুষিয়ে নিতেও রফিকুল আমীনকেই প্রয়োজন তাদের।

কুমিল্লা থেকে আগত আরিফ নামের একজন পরিবেশক বলেন, ‘রফিকুল আমিনের কাছেই আমাদের বিনিয়োগ নিরাপদ। তার ওপর আমাদের কোনোদিন কোনো অভিযোগ ছিল না। তার ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। বিচার ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কারের দাবি তুলছেন কেউ কেউ। তবে আদালতের প্রতি এখনো আস্থা রাখতে চান তারা। ১৫ জানুয়ারি তারা সুবিচার পাবেন বলে আশাবাদী অনেকে।

ডিটিপিএল ও ডিএমসিএসএ এর বিরুদ্ধে করা দুটি মামলায় মোট ৪১০০ কোটি টাকা নয় ছয়ের অভিযোগ করে দুদক। এছাড়া ডেসটিনির ‘দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোতে রফিকুল আমীন অর্থ বিনিয়োগ করেছেন’ দাবি করে এটিকে ‘মানি লন্ডারিং’ বলে আখ্যা দিয়েছে দুদক। ডিএমসিএস’র বিরুদ্ধে করা মামলার চার্জশিটে গত ১২ বছরে তিন শতাধিক সাক্ষী আদালতে হাজির করে দুদক।
এদের মধ্যে ছিলেন, বিভিন্ন ব্যাংকের ম্যানেজার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, জয়েট স্টকের কমকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে অবাক করার বিষয়, ৮ লাখ ৫৫ হাজার ৪২৯ জন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একজন ব্যক্তিতেও সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির করেনি দুদক। অথচ মামলা হয়েছে কিনা তাদের স্বার্থ রক্ষায়। ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদানসহ ডেসটিনি মোট ব্যয় করেছিল ৫১০৫ কোটি টাকা।

শুধু তাই নয়, ডিস্ট্রিবিউটরদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য কমিশন বাবদ প্রদান করা হয় ১৪৫৬ কোটি টাকা। ডিস্ট্রিবিউটরদের ডিন সিআইডি নম্বর দিয়ে সার্ভারে খোঁজ করলে সহজেই এর প্রমাণ মিলে যায়। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১৪২ কোটি টাকা, যার প্রমাণ রয়েছে ব্যাংকের এলসিগুলোতে। সরকারি কোষাগারে ট্যাক্স-ভ্যাট বাবদ প্রদান করা হয় ৪১০ কোটি। এ ছাড়া স্থানীয় পণ্য ক্রয়ে ২৮৭ কোটি টাকা। শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ বাবদ ২৪১ কোটি প্রদান করা হয়। ১২ ছরে বেতন ভাতাদি এবং প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হয় ৪৩৭ কোটি টাকা। এছাড়াও আমানতকারীদের সুদ বাবদ ২৬ কোটি, বৃক্ষরোপন ব্যয় খাতে ২২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়। বিভিন্ন সম্পদ ক্রয়, সিএসআর ও সদস্যদের ঋণ প্রদান বাবদ ১৮৮৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। সব মিলিয়ে মোট দাঁড়ায় ৫১০৫ কোটি টাকা। ব্যয় হওয়া এসব অর্থের বিষয়েও কিছুই উল্লেখ করা হয়নি মামলার চার্জশিটে।

অযত্ন-অবহেলায় বৃক্ষ প্রকল্পসহ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত এছাড়াও দুদকের মামলার ফলে ২০১২ সালের পর থেকে ডেসটিনির কোনো প্রকল্পে বা সম্পত্তিতে না কোনো তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ। দুদকের পক্ষ থেকে ডেসটিনির বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির জন্য রিসিভার নিয়োগ করা হলেও নিশ্চিত করা হয়নি রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির ব্যবস্থা। ফলে বছরের পর বছরের ধরে এসব সম্পত্তির যথেষ্ঠ ব্যবহার করে পুলিশ থেকে শুরু করে দুর্বৃত্তরা। এনিয়ে দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোতে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। লাখো গ্রাহকের অর্থে বিনিয়োগ করা এসব সম্পদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে তার সঠিক কোনো উত্তর নেই। সময়োচিত পরিবেশবান্ধব এ বিনিয়োগের এমন বেহাল দশা দেখে আক্ষেপের শেষ নেই ডেসটিনির ক্রেতা ও পরিবেশকদের।

বিনিয়োকারীদের মনে আশার আলো
ডেসটিনির প্রায় সব গ্রাহক মনে করেন, ন্যায়বিচার পেয়ে রফিকুল আমীন মুক্ত হলে খুলে যেতে পারে তাদের সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। তাই কষ্টার্জিত বিনিয়োগের অর্থ ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধছেন ডেসটিনি ক্রেতা ও পরিবেশকরা।

গত ১১ নভেম্বর আদালতের এজলাসে দাঁড়িয়ে রফিকুল আমীন বলেছিলেন, মাননীয় আদালত আপনি কি রায়দিবেন আমি জানিনা, আপনি যেই রায় দেন আমি আমার ডিস্ট্রিবিউটরদের টাকা ফেরত দিব। কারণ আমার বিনিয়োগকারীরা ধৈর্য ধরে জীবন বাজী রেখে আমার জন্য দীর্ঘ ১২ বছর কাজ করেছেন। এই বিনিয়োগকারীগণ আমার পরিবার সদস্য। আমি সকল অর্থ ফেরত দিতে চাই। তাই আমাদের সম্পদ ও ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেওয়ার অনুমতি চাই। আপনি সুযোগ দিলে আমি আগামী ২০২৫ থেকে টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করব ইনশাআল্লাহ।

লাখো বিনিয়োগকারীর মনে নতুন করে আস্থার সঞ্চার হয়েছে রফিকুল আমীনের এ কথায়। তাদের বিশ্বাস, সম্ভাবনার বিচারে লাভজনক বহু স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে ডেসটিনির। এসব সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকা। ফলে যে কোনো উপায়েই হোক রফিকুল আমীন পাওনা বুঝিয়ে দেবেন বলে দৃঢ় আস্থার কথা জানালেন তারা।