দেশের বিদ্যুৎখাত নিয়ে আর্থিক ক্ষতি আর করপোরেট স্বার্থের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন দেশের আপামর জনগণ। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বিদ্যুৎখাতের সমস্যাগুলো তুলে ধরে এসব সমস্যার কারণ বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছেন এনকেসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জন সাখাওয়াত চৌধুরী।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াট। অথচ চাহিদা কেবল ১৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে চাহিদার অভাব পূরণ করতে হচ্ছে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে। আর দেশজুড়ে নিত্যদিনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছে দেশবাসী।
এ বিষয়ে জন সাখাওয়াত চৌধুরী বলেন, ‘যেখানে আমাদের চাহিদার অর্ধেক উৎপাদন করাই যথেষ্ট, সেখানেও আমরা অর্ধেকের কম বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এর মূল কারণ- জ্বালানি সংকট, পাওনা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থতা ও বিদ্যুৎ খাতের ভুল পরিকল্পনা।’
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিপুল অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর ফলে জনগণের কষ্ট আরও বেড়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেও সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে বাধ্য। জন চৌধুরীর মতে, ‘জনগণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জে চলে যাচ্ছে, অথচ তারা পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ পাচ্ছে না।’
বিদ্যুৎ খাতের সংকটের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে দুর্নীতির। বিগত সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার নানা সিদ্ধান্ত জনস্বার্থবিরোধী বলে মনে করছেন তিনি। তার মতে, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং পছন্দমত ব্যক্তিদের কাজ দেওয়া হয়েছে। আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ভারত থেকে যে বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে, তার মূল্য অন্যান্য বিকল্প উৎসের তুলনায় অনেক বেশি।’
আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি
আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন সাখাওয়াত চৌধুরী। তিনি উল্লেখ করেন, ‘এ চুক্তিতে বাংলাদেশকে একতরফাভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশকে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা কয়লার মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় কম হলেও, বাংলাদেশকে এ বিদ্যুতের জন্য উচ্চ মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়াও, চুক্তিতে ব্যবহৃত কয়লার মান ও সরবরাহের খরচের সঠিক হিসাব প্রায়শই গোপন রাখা হয়।’
জন চৌধুরীরের মতে, ‘এ ধরনের শর্ত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের উপর অর্থনৈতিক বোঝা আরও বাড়িয়ে তুলছে।’
তিনি পরামর্শ দেন, ‘এ চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। একটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য চুক্তির জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। জনগণের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে চুক্তির শর্তগুলো নতুন করে নির্ধারণ করা উচিত।’
স্মার্ট মিটার বির্তক
স্মার্ট মিটার প্রকল্পও সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, স্মার্ট মিটারে লোড করার সময় প্রদত্ত অর্থের চেয়ে কম বিদ্যুৎ ইউনিট পাওয়া যায়। জন চৌধুরী বলেন, ‘স্মার্ট মিটার নামে প্রকৃতপক্ষে ড্যাম মিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া চার্জ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এটি ব্যর্থ।’
তিনি বলেন, ‘স্মার্ট মিটারে একটি বিশেষ প্রোগ্রামিং ত্রুটি বা ইচ্ছাকৃত কারচুপি থাকতে পারে যা গ্রাহকদের জন্য ক্ষতিকারক। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘যখন একজন গ্রাহক ১০০ টাকা লোড করেন, তখন তিনি ৭০ বা ৮০ টাকার সমপরিমাণ ইউনিট পান। এ পার্থক্যের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, সফটওয়্যার বা ডিভাইসে এমন কিছু সেটিংস করা হয়েছে যা গ্রাহকের অজান্তে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
সরকারের প্রতি জন চৌধুরী আহ্বান, ‘মিটারগুলোর প্রযুক্তিগত নিরীক্ষা করতে হবে। জনগণের স্বার্থ রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
আসন্ন গ্রীষ্মকাল ও রমজানে বিদ্যুৎ সংকট আরও জটিল হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জন চৌধুরী। আদানি গ্রুপের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিরোধের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতির সঙ্গে যদি আদানির ৭৫০ মেগাওয়াট সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এ সংকট আরও গভীর হবে।’
সমাধানে প্রস্তাব
>> বিদ্যুৎ খাতে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
>> বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিদ্যমান সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন।
>> অপ্রয়োজনীয় ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল করতে হবে।
>> স্মার্ট মিটার ও অন্যান্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে হবে।
>> আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।
উল্লেখ্য জন সাখাওয়াত চৌধুরী বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন ছাড়া এ খাতের সংকট দূর করা সম্ভব নয়। জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিদ্যুৎখাতে উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
এনকেসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জন সাখাওয়াত চৌধুরী একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। তিনি ফুজিতসু নেটওয়ার্ক কমিউনিকেশনের ইউটিলিটি ডিভিশনের পরিচালক এবং বিভিন্ন খ্যাতনামা আইটি ও ইলেকট্রনিক অ্যাসোসিয়েশনের বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্য। কেমা কিউয়ালিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কেমা কনসালটিংয়ের স্মার্ট গ্রিড ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি ।
তিনি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আমেরিকার ইউটিলিটিগুলোর জন্য স্মার্ট গ্রিড উন্নয়নে কাজ করেছেন। জন ২০০৬ সালে আইবিএম থেকে প্রেসিডেনশিয়াল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ডালাস বিজনেস জার্নাল অনুযায়ী, স্মার্ট গ্রিডের শীর্ষ ২০ বিশেষজ্ঞের একজন। তার পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে।