ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হয়েছেন ‘মেঘমল্লার’ খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষক জাহিদুর রহিম অঞ্জন। সোমবার রাতে বেঙ্গালুরুর স্পর্শ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই গুণী নির্মাতা।
তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া গুণী অঞ্জনের ষাটেই পরলোক যাত্রা মেনে নিতে পারছেন না সতীর্থরা। চলচ্চিত্রকর্মী, নির্মাতা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য অনুরাগী অঞ্জনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন- স্মৃতিচারণ করছেন ব্যক্তিগত দেয়ালে।
অঞ্জনের একটি ছবি শেয়ার করে গুণী নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম লিখেছেন,“শান্তিতে ঘুমাও বন্ধু। কত না বলা কথা রয়ে গেলো। অঞ্জন দেখা হবে তাড়াতাড়ি। জমিয়ে আড্ডা হবে। শারাবান তাহুরা হাতে।”
চলচ্চিত্র আন্দোলনকর্মী ও নির্মাতা মুহম্মদ কাইউম লিখেছেন,“অঞ্জনের ছোট ভাই পান্থর মাধ্যমে গত কয়েকদিন ধরেই নিয়মিত আপডেট পাচ্ছিলাম অঞ্জনের অপারেশন ও পরবর্তী জটিলতা বিষয়ে। দুদিন আগে বলেছিল ধীরে উন্নতি হচ্ছে, হয়তো পোস্ট অপারেটিভ আইসিইউ থেকে বেডে দিয়ে দেবে। গতকাল দুপুরে জানাল সার্বিক অবস্থা ভালো না বিধায় ভেন্টিলেশনে রেখেছে, লিভার ঠিকঠাক কাজ করছে না, তার ওপর কিডনি জটিলতা শুরু হয়েছে, বিপি লো ইত্যাদি। গতকাল সন্ধ্যায় সকল জটিলতার সমাপ্তি ঘটিয়ে অঞ্জন চলে গেল! ১৯৮২ থেকে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল। অঞ্জন, ওর বাবা-ভাইসহ সকলে আমরা এক সংগঠনে কাজ করতাম। মাঝে নানা উত্থান-পতন হলেও সহযোদ্ধা হয়েছিলাম আমরা চলচ্চিত্রের রণাঙ্গনে। বিদায় কমরেড জাহিদুর রহিম অঞ্জন!”
নাট্যকার মাসুম রেজা লিখেছেন,“এইটা কিছু হইলো অঞ্জন… তোমার ছবির শুটিং শুরুর আগে একদিন সারাদিন তুমি আমার সাথে বসে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আড্ডা দিতে.. মেঘমল্লার, চাঁদের অমাবস্যা…। এইতো সেদিনও বললে ‘চিন্তা করিও না মাসুম ভাই ডাক্তার বলছে ঠিক হয়ে যাবে’। আশায় বুক বাঁধলাম, আজ বুকটা ভেঙে গেলো।”
চলচ্চিত্র নির্মাতা আকরাম খান লিখেছেন, “শিক্ষক,বন্ধু,ভাই,সহযাত্রী অঞ্জন দা’র সাথে আমার একটা অংশ চলে গেল।” জাহিদুর রহিম অঞ্জনের একটি ছবি শেয়ার করে ফারুকী লিখেছেন, “জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হলো বড় হওয়া, আর বড় হওয়া মানেই প্রিয় বন্ধুদের হারিয়ে ফেলা!”
চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহাঙ্গীর মুহাম্মদ লিখেছেন,“মেঘমল্লার চলচ্চিত্রের নির্মাতা ও চলচ্চিত্র ও শিক্ষক জাহিদুর রহিম অঞ্জন গতকাল ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ রাতে ব্যাঙ্গালোরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।”
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় অঞ্জনের একটি স্থিরচিত্র শেয়ার করে লিখেছেন, ‘অঞ্জন, তুমিও…’। অভিনেতা মামুনুল হক লিখেন,“শান্তিতে বিশ্রাম নিন, অঞ্জন দা। আপনি আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।” নির্মাতা গোলাম সোহরাব দোদুল লিখেছেন, “অঞ্জন ভাই। এটা কোনো কথা হলো? এভাবে চলে গেলেন? ভালো থাকবেন।”
নির্মাতা অমিতাভ রেজা লিখেছেন,“দাদা…. একটু অপেক্ষা করেন। আসতেছি …. তারকোভস্কি নিয়ে কথাটা বাকী আছে।” অঞ্জনের দীর্ঘদিনের সতীর্থ নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী একটি ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, “আমরা এমনি এসে ভেসে যাই…”।
চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রসূন রহমান লিখেছেন,“বাংলাদেশি সিনেমার জন্য এক শোকাবহ দিন— আমরা হারালাম একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, কর্মী এবং শিক্ষক, যিনি বিশুদ্ধ ও প্রকৃত সিনেমার পক্ষে ছিলেন, গুণগত মানকে সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আমাদের খুব বেশি আলাপের সুযোগ হয়নি, তবে আমরা একই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলাম। আপনার ‘মেঘমল্লার’ এর মাধ্যমে আমি ‘সুতপা’কে আবিষ্কার করেছিলাম। শান্তিতে বিশ্রাম নিন, অঞ্জন দা। কোথাও, কোনো একদিন, আবার দেখা হবে—সেইখানে, যেখানে সকল সিনেমাপ্রেমীর আত্মারা মিলিত হয়।”
লেখক, শিক্ষক ও চলচ্চিত্র সমালোচক ফাহমিদুল হক লিখেছেন,“অঞ্জনদা খুচরো কথার মাধ্যম ফেসবুকে এসে বিশুদ্ধ আর্ট ফর্ম নিয়ে আলাপ করতেন। খুবই বিরল ঘটনা। তিনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা এক ব্যক্তিত্ব। তিনি চলচ্চিত্রের শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি আর্টহাউস সিনেমার প্রমোটার। তিনি ফেসবুকে সবসময় শৈল্পিক চলচ্চিত্র বিষয়ে লিখতেন বা পোস্ট দিতেন। তার টাইমলাইনে ঘুরলে দেখতে পাবেন তিনি তারকোভস্কি, ঋত্বিক বা ব্রেসোঁ নিয়ে লিখছেন, বা তাদের কথা উদ্ধৃতি আকারে তুলে ধরছেন। আর দেখা যাবে তার নির্মিত ছবি ‘মেঘমল্লার’ (২০১৪, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প অবলম্বনে) বা নতুন চলচ্চিত্র ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস অবলম্বনে) নিয়ে পোস্ট। আমি মেঘমল্লার নিয়ে রিভিউ লিখেছিলাম। অনুমান করি, ‘চাঁদের অমাবস্যা’র কাজ প্রায় শেষই। অপেক্ষা করবো পরিবার বা বন্ধুজনেরা ছবিটির অসমাপ্ত কাজ শেষ করে মুক্তি দেবেন। তার প্রস্থান অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে। এই প্রস্থান অকস্মাৎ ও আগাম। তার স্ত্রী শাহীন আখতার গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। জীবনসাথী হারানোর শোক কাটিয়ে উঠুন শাহীন আপা।”
নির্মাতা কাওসার আহমেদ চৌধুরী লিখেছেন,“এ কথাটি বলতে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে, কিন্তু ওটাই সত্যি- অঞ্জন আর নেই! আমাদের দীর্ঘদিনের সাথী, সহযোদ্ধা, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সম্মানিত চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন আর নেই! বাংলাদেশে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন এবং চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে অঞ্জন ছিল সর্বদা সক্রীয়। দীর্ঘ সময় ধরে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং বিসিটিআই’ (বাংলাদেশ সিনেমা এণ্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট)-এ শিক্ষকতা করেছে অঞ্জন- শিক্ষার্থীদের মন জয় করেই। তাঁর চলচ্চিত্র ‘মেঘ মাল্লার’ এ দেশের চলচ্চিত্র প্রেমীদের হৃদয়কে নাড়া দেবে দীর্ঘদিন! অঞ্জন আর নেই- এটা ভাবতেই নিজেকে খুব শুন্য-শুন্য লাগছে! কেন জানি আমাদের চারপাশটা খুব দ্রুতই খালি হয়ে যাচ্ছে! আহা…!”
অঞ্জনের একটি ছবি শেয়ার করে চলচ্চিত্র নির্মাতা ফাখরুল আরেফীন খান লিখেছেন, “জহির রায়হান,আলমগীর কবির, তারেক শাহরিয়ার ও তারেক মাসুদ এর মতোই অঞ্জন দাও চলে গেল -সৃষ্টির কাছে অনেক অনেক ঋণ রেখে। একজন জাহিদুর রহিম অঞ্জন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হওয়া বিরল ও ব্যতিক্রম। অনেক যাত্রা শেষে যখন একজন সৎ চলচ্চিত্র নির্মাতা নির্মাণ হয় অনেক প্রত্যাশা থাকে তাকে ঘিরে…হাসিমুখ চির অম্লান থাকুক প্রিয় অঞ্জন দা।”
চলচ্চিত্র নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী লিখেছেন,“জাহিদুর রহিম অঞ্জন, দ্য আ্যংরি ইয়ং ম্যান অব বাংলা সিনেমা! কোথায় হারিয়ে গেলেন দাদা আমাদের সব মায়া জলাঞ্জলি দিয়ে! শোক ও সন্তাপ শাহীন আপা!”
স্মৃতিচারণ করে জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ লিখেছেন, “সেই খুলনা সেন্ট জোসেফস স্কুল, আমাদের প্রতিটি গান আর ছবি আঁকার প্রতিযোগিতাগুলো! কোথায় ছিলেনা তুমি প্রিয় অঞ্জন দা! কৈশোর থেকে এখন পর্যন্ত একই রকম। পরিবর্তনহীন; রাগদ্বেষহীন শান্ত মানুষটি। আজ চলে গেলে…।”
মুক্তির প্রতীক্ষায় আছে অঞ্জনের ছবি ‘চাঁদের অমাবস্যা’। যে ছবিতে অভিনয় করেছেন দীপান্বিতা মার্টিন। অঞ্জনের মৃত্যুতে স্বভাবতই শোকাচ্ছন্ন অভিনেত্রী। লিখেছেন,“দাদা এটা কেমন কথা? এমন তো কথা ছিলোনা। তুমি তো আমাকে সাহস দিলে নিরাপদ থাকতে বললে সাথে এও বললে যে তুমি ফিরে আসবে দেখা হবে বললে দাদা! এ কেমন চাঁদের অমাবস্যা দাদা? না দাদা প্লিজ না!”