ঢাকা , মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিস

বাইরের লোক দিয়ে চলে কম্পিউটারে কাজ, সরকারি ফির ১০ গুণ আদায়

ভূমি অফিসে দালালের মাধ্যমে কাজ করা বা সরকারি ফি’র চেয়ে বেশি টাকা নেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে দিনাজপুরে দালাল নয়, সরকারি দফতরের কেউ না হয়েও কার্যালয়ের কম্পিউটারে বসে লোকজনকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। আর বিনিময়ে প্রতিজন সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে সরকারি ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ১০ থেকে ৪০ গুণ টাকা।

ঘটনাটি দিনাজপুর সদর উপজেলার শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে ভূমি অফিসের তহশিলদার এ প্রতিবেদককে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সংবাদটি প্রকাশ না করতে তদবিরও করেন তিনি।

শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সরেজমিনে গিয়ে হলে দেখা যায়, সরকারি দফতরের কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করছেন স্বপন রায়। পাশেই একজন সেবাগ্রহীতা। সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে কিছুক্ষণ তাদের কার্যক্রম খেয়াল করেন প্রতিবেদক। দেখা যায়, ভূমি অফিসে যারা জমির খাজনা দিতে আসছেন তাদের সব কাজ করে দিচ্ছেন স্বপন রায়। অফিসের বারান্দায় রয়েছেন ঝাড়ুদার সাগর। কোনও মানুষ এলে তার কী সমস্যা জেনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্বপনের কাছে। আবার কেউ কেউ সরাসরি চলে যাচ্ছেন স্বপনের কাছে। দুয়েকজন এসে অফিস সহায়ক আজাহার আলীর কাছে যাচ্ছেন। তিনিও পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্বপনের কাছে। আর কার্যালয়ে বসে রয়েছেন তহশিলদার বা ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা আবুল কাশেম।

স্বপন নামে ওই ব্যক্তি কার্যালয়ের কেউ না হয়েও জমি সংক্রান্ত কাজই যে শুধু কাজ করে দিচ্ছে তা নয়, বিনিময়ে প্রতি কাজের জন্য নিচ্ছেন সরকারি ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ১০ থেকে ৪০ গুণ বেশি অর্থ। টাকা জমা না দিলে কাজ হবে না, সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, জমি সংক্রান্ত কোনও কাজ করতে হলে দিতে হয় চাহিদা মাফিক টাকা। টাকা না দিলেই হতে হয় হয়রানির শিকার। কৃষকদের হয়রানি করায় আপত্তি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও।

স্থানীয় কৃষক ফিরোজুল ইসলাম বলেন, ‘২৯ শতক জমির খাজনা দিতে আইসছি। মোর (আমার) কাছত ২৪ হাজার টাকা চাইছে। টাকা দিতে পারি না, কাজও হয় নাই। এইলা খুব কাহিচাল। এইলা ধরাধরি না করিলে মানুষক জ্বলাই-পুড়াই শ্যাষ করি দিবে। স্বপন অফিসের কেউ না, এটা তো আমরা জানি না। সব টাকা তো সেই চাইছে। অফিসের কেউ না হলে কি টাকা চায়, আর অফিসের ভেতরে বসে কাজ করতে পারে?’

ওই এলাকার আরেক কৃষক সিরাজুল বলেন, ‘ওদের কাছে গেইলে বলে এইটা নাই, প্রিন্টার নাই, এইটা সমস্যা, ওইটা সমস্যা। এসব দেখিয়ে বলে, ৪ হাজার দেন। ফির আবার দুই সপ্তাহ, এক মাস ঘুরেন। ঘুরার পর আবার দেন এক হাজার, দুই হাজার। এভাবে আমাদের হয়রানি করাচ্ছে। তারপরও সেবা ঠিক মতন পাওয়া যাচ্ছে না। ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে অবস্থা খারাপ। এর আগে আমার বাবা খারিজ করতে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা পারি না, অন্য লোক বা তৃতীয় পক্ষ দিয়ে করতে হয়েছে। আমাদের ২৪ হাজার টাকার মতো লাগিছে। ৩ বিঘা মতো জমি (১৪৬ শতক)। এরপরও তো বাড়তি বিভিন্ন অজুহাতে মানুষকে টাকা দিতে হয়েছে দুই হাজার, এক হাজার করে। স্বপনই তো সব কাজ করে, টাকাও নেয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কৃষক বলেন, ‘হারা (আমরা) তো কানা (স্বাক্ষরজ্ঞানহীন) মানুষ। কম্পিউটারত টিপিয়া কহেছে এতো আইছে। হারা কিছু জানি না। এখন টাকা দিবা হইছে। আড়াই শতক জমিতে ২ হাজার টাকা দিবা হইছে, কহেছে আইছে এইটা। হামরা তো কাগজে কিছু বুঝি না।’ স্বপনকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই লোক আমার কাছে টাকা নিয়েছে। তার ৪ বছরের খাজনা বাকি থাকলে আড়াই শতক জমির খাজনা দাঁড়ায় ৫০ টাকার মতো। অথচ নিয়েছে ২ হাজার টাকা!’

কৃষকদের কাছে খাজনা নেওয়ার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হলে জানা যায়, ভূমি অফিসে খাজনার জন্য নগদ অর্থ গ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করবে ভূমি অফিস, আর কৃষকরা তাদের খাজনা অনলাইনের মাধ্যমে জমা দেবে। কৃষকদের জমির ৮ দশমিক ২৫ একর পর্যন্ত মওকুফি খাজনা। এতে বছরে শতক প্রতি সর্বোচ্চ ২০ টাকা করে নেওয়া যেতে পারে।

সদর উপজেলার শশরা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর আনাফ বলেন, যে কোনও বিষয়ে জনগণ যেন সাফার না করে। কারণ একটা মানুষের কাছ থেকে নির্দিষ্ট ফি থেকে অধিক আদায় করা তো অন্যায়। যদি তহশিল অফিসের ব্যক্তিরা বেশি ফি নেয় তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এটা অন্যায়, দুর্নীতি। তারা একটা সরকারি দফতরে কাজ করতেছে। তহশিলদার একজন সরকারি লোক, এসিল্যান্ড আছেন, ইউএনও সাহেব আছেন। তারা বিষয়টি জানেন কী জানেন না, আমি জানি না। এমন হওয়ার কথা না যে, সরকারি দফতরে বাইরের কেউ একজন কাজ করবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানবে না। অবশ্যই জানবে বলে আমি মনে করি। উনি কে, কোথায়, কে তাকে নিয়োগ করলো? ভাবা উচিত তো। সরকারি কাজকর্ম, সরকারি কাগজপত্র হ্যান্ডেলিং করতেছে উনি, উনি সরকারি চাকরিজীবী না হয়েও যদি এটা করে তাহলে কারণটা কী? এটা আইনগতভাবে খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি।

যদিও টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন স্বপন। আর স্টাফ না হয়েও কেন সরকারি দফতরের দায়িত্বে এ ব্যাপারে দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তহশিলদার ও সহকারী। এক পর্যায়ে সংবাদটি না করার জন্য দেন অর্থের প্রস্তাব। এই প্রতিনিধির পকেটে ‘মিষ্টি খাওয়ার’ টাকাও ‍পুরে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

নিয়োগ ছাড়াই সরকারি দফতরের কম্পিউটারে কাজ করার ব্যাপারে জানতে স্বপন রায়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি খানসামা উপজেলায়। আমি প্রায় ২ বছর ধরে এখানে আছি। আমি এখানে চুক্তিভিত্তিক, তাদের বেতন থেকে আমাকে টাকা দেয়।’

চুক্তিপত্র আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনও চুক্তিপত্র নাই, মৌখিক চুক্তি।’

অন্যের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মানুষ স্বেচ্ছায় দিলে নেই। তাছাড়া টাকা নেই না।’

ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক আজাহার আলী বলেন, ‘স্বপন এখানে কম্পিউটার চালায়। আমার আসার প্রায় ৩ মাস হলো। আমি এসে দেখছি স্বপন এখানে আছেন। আমাদের যিনি বস তিনি স্বপনকে রেখেছেন।’

শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার চাকরি শেষের দিকে। বয়সের কারণে আমি কম্পিউটার চালাতে পারি না। সেজন্য স্বপন নামে ছেলেকে কম্পিউটারে কাজের জন্য নিজে রেখেছি। সে আগে থেকেই ছিল, এখন আমার দায়িত্বে রয়েছে। ২ বছর ধরে এখানে আছে। তার স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী কোনও নিয়োগ নাই।’

কোনও নিয়োগ ছাড়া সরকারি অফিসের কম্পিউটারে বসে অন্য কেউ কাজ করতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কম্পিউটার চালাতে পারি না বলে আমার পরিবর্তে একটা লোক রেখে দিয়েছি, আর অন্য কিছু বলতে পারবো না। কাজের স্বার্থে আমাকে তাকে রাখতে হয়েছে।’ বাইরের কোনও মানুষ সরকারি অফিসে কাজ করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পারে না, কিন্তু যেহেতু আমি কম্পিউটার চালাতে পারি না সেজন্য তাকে রেখেছি।’ বেশি টাকা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখানে বেশি টাকা নিতে পারে না। এটা আমার জানা নাই। আমি যেহেতু কম্পিউটার জানি না এজন্য সমস্ত দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে।’

সরকারি দফতরের কম্পিউটারে বাইরের কেউ কাজ করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ প্রতারিত হলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা হার্ডলাইনে আছি যে, আমাদের সাধারণ মানুষ তারা যদি প্রান্তিক পর্যায়ের কোনও কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রতারিত হন তাহলে চূড়ান্ত করে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প নাই। আমি আমাদের জায়গা থেকে বলতে পারি— যেই ধরনের অভিযোগ আমরা পাচ্ছি, এগুলো আমরা অতীতেও তদন্ত করেছি এবং এই অভিযোগটার ক্ষেত্রে বিশেষ করে এতটুকু কথা দিতে পারি যে চূড়ান্ত এবং শক্ত এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ আপনারা দেখতে পাবেন যদি অভিযোগগুলো আমরা প্রমাণ করতে পারি।’

জনপ্রিয় সংবাদ

‘কে জানত, সেই বিজয় হবে রক্তে লেখা এক ইতিহাসের নাম’

শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিস

বাইরের লোক দিয়ে চলে কম্পিউটারে কাজ, সরকারি ফির ১০ গুণ আদায়

আপডেট সময় ০৫:২২:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫

ভূমি অফিসে দালালের মাধ্যমে কাজ করা বা সরকারি ফি’র চেয়ে বেশি টাকা নেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে দিনাজপুরে দালাল নয়, সরকারি দফতরের কেউ না হয়েও কার্যালয়ের কম্পিউটারে বসে লোকজনকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। আর বিনিময়ে প্রতিজন সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে সরকারি ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ১০ থেকে ৪০ গুণ টাকা।

ঘটনাটি দিনাজপুর সদর উপজেলার শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে ভূমি অফিসের তহশিলদার এ প্রতিবেদককে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সংবাদটি প্রকাশ না করতে তদবিরও করেন তিনি।

শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সরেজমিনে গিয়ে হলে দেখা যায়, সরকারি দফতরের কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করছেন স্বপন রায়। পাশেই একজন সেবাগ্রহীতা। সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে কিছুক্ষণ তাদের কার্যক্রম খেয়াল করেন প্রতিবেদক। দেখা যায়, ভূমি অফিসে যারা জমির খাজনা দিতে আসছেন তাদের সব কাজ করে দিচ্ছেন স্বপন রায়। অফিসের বারান্দায় রয়েছেন ঝাড়ুদার সাগর। কোনও মানুষ এলে তার কী সমস্যা জেনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্বপনের কাছে। আবার কেউ কেউ সরাসরি চলে যাচ্ছেন স্বপনের কাছে। দুয়েকজন এসে অফিস সহায়ক আজাহার আলীর কাছে যাচ্ছেন। তিনিও পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্বপনের কাছে। আর কার্যালয়ে বসে রয়েছেন তহশিলদার বা ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা আবুল কাশেম।

স্বপন নামে ওই ব্যক্তি কার্যালয়ের কেউ না হয়েও জমি সংক্রান্ত কাজই যে শুধু কাজ করে দিচ্ছে তা নয়, বিনিময়ে প্রতি কাজের জন্য নিচ্ছেন সরকারি ফি’র চেয়ে অতিরিক্ত ১০ থেকে ৪০ গুণ বেশি অর্থ। টাকা জমা না দিলে কাজ হবে না, সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, জমি সংক্রান্ত কোনও কাজ করতে হলে দিতে হয় চাহিদা মাফিক টাকা। টাকা না দিলেই হতে হয় হয়রানির শিকার। কৃষকদের হয়রানি করায় আপত্তি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও।

স্থানীয় কৃষক ফিরোজুল ইসলাম বলেন, ‘২৯ শতক জমির খাজনা দিতে আইসছি। মোর (আমার) কাছত ২৪ হাজার টাকা চাইছে। টাকা দিতে পারি না, কাজও হয় নাই। এইলা খুব কাহিচাল। এইলা ধরাধরি না করিলে মানুষক জ্বলাই-পুড়াই শ্যাষ করি দিবে। স্বপন অফিসের কেউ না, এটা তো আমরা জানি না। সব টাকা তো সেই চাইছে। অফিসের কেউ না হলে কি টাকা চায়, আর অফিসের ভেতরে বসে কাজ করতে পারে?’

ওই এলাকার আরেক কৃষক সিরাজুল বলেন, ‘ওদের কাছে গেইলে বলে এইটা নাই, প্রিন্টার নাই, এইটা সমস্যা, ওইটা সমস্যা। এসব দেখিয়ে বলে, ৪ হাজার দেন। ফির আবার দুই সপ্তাহ, এক মাস ঘুরেন। ঘুরার পর আবার দেন এক হাজার, দুই হাজার। এভাবে আমাদের হয়রানি করাচ্ছে। তারপরও সেবা ঠিক মতন পাওয়া যাচ্ছে না। ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে অবস্থা খারাপ। এর আগে আমার বাবা খারিজ করতে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা পারি না, অন্য লোক বা তৃতীয় পক্ষ দিয়ে করতে হয়েছে। আমাদের ২৪ হাজার টাকার মতো লাগিছে। ৩ বিঘা মতো জমি (১৪৬ শতক)। এরপরও তো বাড়তি বিভিন্ন অজুহাতে মানুষকে টাকা দিতে হয়েছে দুই হাজার, এক হাজার করে। স্বপনই তো সব কাজ করে, টাকাও নেয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কৃষক বলেন, ‘হারা (আমরা) তো কানা (স্বাক্ষরজ্ঞানহীন) মানুষ। কম্পিউটারত টিপিয়া কহেছে এতো আইছে। হারা কিছু জানি না। এখন টাকা দিবা হইছে। আড়াই শতক জমিতে ২ হাজার টাকা দিবা হইছে, কহেছে আইছে এইটা। হামরা তো কাগজে কিছু বুঝি না।’ স্বপনকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই লোক আমার কাছে টাকা নিয়েছে। তার ৪ বছরের খাজনা বাকি থাকলে আড়াই শতক জমির খাজনা দাঁড়ায় ৫০ টাকার মতো। অথচ নিয়েছে ২ হাজার টাকা!’

কৃষকদের কাছে খাজনা নেওয়ার ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হলে জানা যায়, ভূমি অফিসে খাজনার জন্য নগদ অর্থ গ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করবে ভূমি অফিস, আর কৃষকরা তাদের খাজনা অনলাইনের মাধ্যমে জমা দেবে। কৃষকদের জমির ৮ দশমিক ২৫ একর পর্যন্ত মওকুফি খাজনা। এতে বছরে শতক প্রতি সর্বোচ্চ ২০ টাকা করে নেওয়া যেতে পারে।

সদর উপজেলার শশরা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর আনাফ বলেন, যে কোনও বিষয়ে জনগণ যেন সাফার না করে। কারণ একটা মানুষের কাছ থেকে নির্দিষ্ট ফি থেকে অধিক আদায় করা তো অন্যায়। যদি তহশিল অফিসের ব্যক্তিরা বেশি ফি নেয় তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এটা অন্যায়, দুর্নীতি। তারা একটা সরকারি দফতরে কাজ করতেছে। তহশিলদার একজন সরকারি লোক, এসিল্যান্ড আছেন, ইউএনও সাহেব আছেন। তারা বিষয়টি জানেন কী জানেন না, আমি জানি না। এমন হওয়ার কথা না যে, সরকারি দফতরে বাইরের কেউ একজন কাজ করবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানবে না। অবশ্যই জানবে বলে আমি মনে করি। উনি কে, কোথায়, কে তাকে নিয়োগ করলো? ভাবা উচিত তো। সরকারি কাজকর্ম, সরকারি কাগজপত্র হ্যান্ডেলিং করতেছে উনি, উনি সরকারি চাকরিজীবী না হয়েও যদি এটা করে তাহলে কারণটা কী? এটা আইনগতভাবে খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি।

যদিও টাকা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন স্বপন। আর স্টাফ না হয়েও কেন সরকারি দফতরের দায়িত্বে এ ব্যাপারে দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তহশিলদার ও সহকারী। এক পর্যায়ে সংবাদটি না করার জন্য দেন অর্থের প্রস্তাব। এই প্রতিনিধির পকেটে ‘মিষ্টি খাওয়ার’ টাকাও ‍পুরে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

নিয়োগ ছাড়াই সরকারি দফতরের কম্পিউটারে কাজ করার ব্যাপারে জানতে স্বপন রায়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি খানসামা উপজেলায়। আমি প্রায় ২ বছর ধরে এখানে আছি। আমি এখানে চুক্তিভিত্তিক, তাদের বেতন থেকে আমাকে টাকা দেয়।’

চুক্তিপত্র আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনও চুক্তিপত্র নাই, মৌখিক চুক্তি।’

অন্যের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মানুষ স্বেচ্ছায় দিলে নেই। তাছাড়া টাকা নেই না।’

ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক আজাহার আলী বলেন, ‘স্বপন এখানে কম্পিউটার চালায়। আমার আসার প্রায় ৩ মাস হলো। আমি এসে দেখছি স্বপন এখানে আছেন। আমাদের যিনি বস তিনি স্বপনকে রেখেছেন।’

শশরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার চাকরি শেষের দিকে। বয়সের কারণে আমি কম্পিউটার চালাতে পারি না। সেজন্য স্বপন নামে ছেলেকে কম্পিউটারে কাজের জন্য নিজে রেখেছি। সে আগে থেকেই ছিল, এখন আমার দায়িত্বে রয়েছে। ২ বছর ধরে এখানে আছে। তার স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী কোনও নিয়োগ নাই।’

কোনও নিয়োগ ছাড়া সরকারি অফিসের কম্পিউটারে বসে অন্য কেউ কাজ করতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কম্পিউটার চালাতে পারি না বলে আমার পরিবর্তে একটা লোক রেখে দিয়েছি, আর অন্য কিছু বলতে পারবো না। কাজের স্বার্থে আমাকে তাকে রাখতে হয়েছে।’ বাইরের কোনও মানুষ সরকারি অফিসে কাজ করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পারে না, কিন্তু যেহেতু আমি কম্পিউটার চালাতে পারি না সেজন্য তাকে রেখেছি।’ বেশি টাকা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখানে বেশি টাকা নিতে পারে না। এটা আমার জানা নাই। আমি যেহেতু কম্পিউটার জানি না এজন্য সমস্ত দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে।’

সরকারি দফতরের কম্পিউটারে বাইরের কেউ কাজ করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ প্রতারিত হলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা হার্ডলাইনে আছি যে, আমাদের সাধারণ মানুষ তারা যদি প্রান্তিক পর্যায়ের কোনও কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রতারিত হন তাহলে চূড়ান্ত করে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প নাই। আমি আমাদের জায়গা থেকে বলতে পারি— যেই ধরনের অভিযোগ আমরা পাচ্ছি, এগুলো আমরা অতীতেও তদন্ত করেছি এবং এই অভিযোগটার ক্ষেত্রে বিশেষ করে এতটুকু কথা দিতে পারি যে চূড়ান্ত এবং শক্ত এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ আপনারা দেখতে পাবেন যদি অভিযোগগুলো আমরা প্রমাণ করতে পারি।’