ঢাকা , মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের অপার সম্ভাবনা

  • ডেসটিনি ডেস্ক
  • আপডেট সময় ০২:৫৯:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫
  • ২৯ বার পড়া হয়েছে

বিত্তবান মুসলমানদের জন্য জাকাত ফরজ। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি বাংলাদেশে সঠিকভাবে জাকাত আদায় হয়, তাহলে এক বছরে তার পরিমাণ হবে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি।

ইসলামি চিন্তাবিদ, বিশ্লেষক ও জাকাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সঠিকভাবে জাকাত আদায় ও বিতরণ করা হলে বাংলাদেশে এক সময় হয়তো জাকাত দেয়ার লোক পাওয়া যাবে না।

ইসলামের বিধান মতে, কোনো মুসলমানের যদি বছর শেষে কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্যের সম পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে তার জাকাত দেয়া ফরজ। স্বর্ণের হিসাব ধরলে বর্তমান বাজার দরে কম-বেশি ১১ লাখ টাকার সম্পদ থাকলেই মোট সম্পদের জাকাত দিতে হবে। তবে একমাত্র স্বর্ণালঙ্কার ছাড়া আর কোনো ব্যবহার্য জিনিসের জাকাত দিতে হয় না। নিজের বাড়িরও জাকাত নেই। জাকাত দিতে হয় প্রতি বছর মোট জাকাতযোগ্য (নিসাব) সম্পদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি জাকাত বোর্ড আছে। এর বাইরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আর কোনো জাকাত আদায় হয় না। কিন্তু বেসরকারিভাবে জাকাত নেয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে। আর ব্যক্তিগতভাবে জাকাত দেয়ার রেওয়াজই এখানে বেশি। ১৯৮২ সাল থেকে আইনের অধীনে জাকাত বোর্ড কাজ করছে। তারা জাকাত ফান্ডে জাকাতের অর্থ নেয়।

জাকাত ফান্ডের উপ-পরিচালক মো. আবুল কাসেম জানান, চলতি বছরে তাদের জাকাত ফান্ডে ১১ কোটি টাকা জমা পড়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে বা সরাসরি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গিয়ে জাকাতের টাকা জমা দেয়া যায়। গরিব মানুষের মধ্যে জাকাত বিতরণ হয় নির্ধারিত ফর্মে আবেদনের ভিত্তিতে।

তিনি বলেন, জাকাত হলো গরিবের হক। এটা কোনো অনুদান বা করুণা নয়। আমরা প্রকৃত বিত্তহীন মুসলমানদের বাছাই করে জাকাত দিই। এছাড়া জাকাতের অর্থে গরিব মানুষের জন্য তাদের সাবলম্বী করার কিছু প্রকল্প এবং টঙ্গীতে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পরিচলনা করা হয়।

জাকাত হিসাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে সেলাই মেশিন ও রিকশা, ভ্যান দেয়া হয়। নগদ টাকাও দেয়া হয়। এছাড়াও গরিব পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা ভাতা দেয়া হয়। নগদ টাকাও দেয়া হয়। এটা সর্বনিম্ন সাত হাজার টাকা আর সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা । এই জাকাতের টাকায় সারাদেশের ৩৪ জেলায় একটি করে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করা হয় বিনামূল্যে। প্রতি ব্যাচ থেকে তিন জনকে সেলাই মেশিন দেয়া হয়।

তিনি জানান, প্রতিবছর ৮০ হাজারের মতো জাকাত নেয়ার আবেদন আসে। গড়ে ৫০ হাজারের মতো ব্যাক্তিকে প্রতি বছর জাকাত ফান্ড থেকে সহায়তা করা হয়।

তিনি বলেন, এখন জাকাত ফান্ডে জাকাত দেয়ার আগ্রহ বাড়ছে। শুরুতে বছরে এক কোটি টাকাও পাওয়া যেতো না। অনলাইনে আমাদের জাকাত ক্যালকুলেটর আছে। সেখান থেকেই যে কেউ তার জাকাতের হিসাব করতে পারেন। আর নগদ বা সোনালী ব্যাংকের যে-কোনো শাখায় জাকাতের টাকা জমা দেয়া যায়।

কিন্তু সরকারের জাকাত ফান্ডে জমা পড়া এই অর্থ বাংলাদেশে জাকাতের অর্থের যে সম্ভাবনা আছে, তার অতি সামান্যই।

বাংলাদেশের জাকাতের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এমরানুল হক। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের কিছু অর্থনীতিবিদ জাকাতের সম্ভাবনার হিসাব করে দেখিয়েছিলেন। সেটা ছিল তখনকার জিডিপির ৩.৭৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেটা ধরে আমি একটা গবেষণা করি। তাতে জিডিপি বিবেচনায় আমার হিসাবে বছরে ১৯০ হাজার কোটি টাকারও ওপরে জাকাত কালেকশন করা সম্ভব। সেখানে আমাদের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হলো ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর তার উপকারভোগী এক কোটি নিম্নবিত্ত মানুষ।

তিনি এই হিসাব করেছেন ব্যক্তি ধরে নয়। মানুষের ব্যাংকে জমানো টাকা ও সম্পদ ধরে। কৃষি সম্পদসহ আরও যেসব ব্যাংকিং টুলস আছে সেগুলো ধরে। আর শুধু ব্যক্তি নয়, কর্পোরেট জাকাতও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ‘জাকাত ফেয়ার’ অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের জাকাত দিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং গরিব মানুষের কল্যাণে এই জাকাতের টাকা ব্যবহারের বিভিন্ন মডেল উপস্থাপন। মেলার আয়োজন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম) । সেখানে এক সেমিনারে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায় করা সম্ভব। মানুষকে জাকাত আদায়ে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হলে ১০ বছরের মধ্যে এ দেশে ভিক্ষা করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশর সামর্থ্যবান মুসলমানরা বছরে মোট কত টাকা জাকাত দেন, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে তা বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা হবে বলে জানান সিজেডএম-এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক ওয়েছ খান নূর সোহেল। তিনি বলেন, গত বছর আমরা ৫০০ কোটি টাকার জাকাত সংগ্রহ করেছি। আমরা ছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত সংগ্রহ করে। আর ব্যক্তি পর্যায়েও অনেক জাকাত দেয়া হয়। আমি জাকাত সংগ্রহকারী বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে কত জাকাত দেয়া হয় তারা ধারণা করেছি।

সিজেডএম বাংলাদেশে নিবন্ধিত জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। তারা জাকাত আদায়ই শুধু নয়, এর ব্যবস্থাপনা নিয়েও কাজ করে। কীভাবে জাকাত আদায় বাড়ানো যায় এবং সঠিকভাবে মানুষকে স্বাবলম্বী করার জন্য বিতরণ করা যায়, তা নিয়ে তাদের মডেল প্রজেক্টও আছে।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, আটটি ক্ষেত্রে জাকাতের অর্থ খরচ করা যায়। ১. ফকির ( ভিক্ষুক) ২. মিসকিন (অভাবগ্রস্ত) ৩. জাকাত আদায় ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা ৪. অমুসলিম (ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য) ৫. দাস মুক্তি ৬. ঋণগ্রস্ত ৭. আল্লাহর রাস্তায় ৮. বিপদগ্রস্ত মুসাফির।

ওয়েছ খান নূর সোহেল বলেন, জাকাতের নামে লাইন দিয়ে শাড়ি বা লুঙ্গি দেয়া বা দান খয়রাত করা ইসলামের আদর্শের সঙ্গে যায় না। ইসলাম ব্যক্তির আত্মমর্যাদাকে খুব গুরুত্ব দেয়। জাকাত হলো গরিবের হক বা অধিকার। ফলে গরিবের হক তার প্রয়োজন মতো দিতে হবে। প্রতি বছর একজনকে একটি করে শাড়ি দিলে তার অভাব কি পুরণ হবে? দেখা যাবে তার শাড়ির প্রয়োজন নাই। আসলে গরিবকে সাবলম্বী করার জন্যই জাকাত দেয়া উচিত।

হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানি বলেন, আসলে দেশে যেসব বিত্তবান মুসলমান, যাদের জাকাত ফরজ তাদের বড় একটি অংশ জাকাত দেন না। আবার ইসলামের নিয়ম মেনে যে পরিমাণ জাকাত দেয়া দরকার, সেই পরিমাণও দেন না। অনেকেই জাকাত দেন শড়ি, লুঙ্গি। এগুলো লোক দেখানো। কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেন। মেম্বার, চেয়ারম্যান এমপি হওয়ার জন্য। ফলে জাকাতের সুফল পাওয়া যায় না। অথবা জাকাতের আসল লক্ষ্য অর্জিত হয় না। যদি গরিবের হক হিসাবে জাকাত দেয়া হতো, তাহলে আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে কয়েক বছর পর জাকাত নেয়ার মতো লোক থাকতো না।

তার কথা, এখানে যারা জাকাত দেন, তাদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাকাত দেন। কারণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের আস্থা নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের কাজ করে। কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আস্থা অর্জন করছে। ইসলামী রাষ্ট্র না হওয়ায় ফরজ হলেও এখানে মুসলানদের জাকাত দিতে বাধ্য করা যাচ্ছে না। তবে সেটা না হলেও ফরজ হিসাবে সামর্থ্যবান মুসলমানের সঠিক পরিমাণে জাকাত দিতে হবে। না দিলে সে গুণাহগার হবে।

নাগরিকরা সরকারকে প্রতিবছর যে আয়কর দেন, তার সঙ্গে জাকাতের পার্থক্য আছে। আয়কর দিতে হয় বর্ধিত আয়ের ওপর। যে আয়ের ওপর একবার কর দেয়া হয়েছে, সেই আয়ের ওপর আর কর দিতে হয় না। কিন্তু মুসলমানদের নির্ধারিত (নিসাব) পরিমাণ সম্পদ থাকলেই প্রতিবছর জাকাত দিতে হবে। আর সরকারকে আয়কর দিলে ইসলামে জাকাত মাফ হবে না। আয়কর দিলেও জাকাত দিতে হবে বলে জানান মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী।

ওয়েছ খান নূর সোহেল বলেন, আমরা ধারণা করি, দেশে পাঁচ কোটি মুসলমান জাকাত দেয়ার যোগ্য। তারা সবাই জাকাত দিলে দারিদ্র্য দূর করা অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা। দান খয়রাত বিবেচনায় জাকাত দিলে হবে না। গরিব মানুষকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে, তাদের সন্তানদের পড়া-লেখা, চিকিৎসাসহ আরো অনেক খাতে ইসলামের নিয়ম মেনে জাকাত দেয়া যায়। আর সেই পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয়ভাবেও হতে পারে।

আর অধ্যাপক ড. এম এমরানুল হক বলেন, আমরা বাজেটে যে অর্থ ব্যয় করি দারিদ্র্য বিমোচনে এক বছরে তার চৌদ্দগুণ বেশি অর্থ এক বছরের জাকাত থেকে আসতে পারে। আর জাকাতের অর্থ ফেরত দিতে হয় না। এরজন্য সুদ দিতে হয় না। কিন্তু বাজেটে যে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা নেয়া হয়, তা সুদে-আসলে ফেরত দিতে হয়। তাই দারিদ্র্য দূর করতে জাকাত একটি বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। এই খাতকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা।

“সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির কারণে যেহেতু মানুষের আস্থার জায়গায় নেই, তাই দেশের শীর্ষ আলেম ও ইসলামী চিন্তবিদদের সমন্বয়ে জাতীয় শরিয়াহ বোর্ড করে তাদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে জাকাত আদায় ও বিতরণ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয়া যায়,” বলেন মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানি। তার কথা, ধনীদের সম্পদের ওপর গরিবের হক আছে। এটা সমাজে ভারসাম্য তৈরি করে। আর সেটা যদি আদায় না করা হয়, তাহলে সমাজে ভারসাম্য তৈরি হবে না।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের অপার সম্ভাবনা

আপডেট সময় ০২:৫৯:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ মার্চ ২০২৫

বিত্তবান মুসলমানদের জন্য জাকাত ফরজ। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি বাংলাদেশে সঠিকভাবে জাকাত আদায় হয়, তাহলে এক বছরে তার পরিমাণ হবে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি।

ইসলামি চিন্তাবিদ, বিশ্লেষক ও জাকাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সঠিকভাবে জাকাত আদায় ও বিতরণ করা হলে বাংলাদেশে এক সময় হয়তো জাকাত দেয়ার লোক পাওয়া যাবে না।

ইসলামের বিধান মতে, কোনো মুসলমানের যদি বছর শেষে কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্যের সম পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে তার জাকাত দেয়া ফরজ। স্বর্ণের হিসাব ধরলে বর্তমান বাজার দরে কম-বেশি ১১ লাখ টাকার সম্পদ থাকলেই মোট সম্পদের জাকাত দিতে হবে। তবে একমাত্র স্বর্ণালঙ্কার ছাড়া আর কোনো ব্যবহার্য জিনিসের জাকাত দিতে হয় না। নিজের বাড়িরও জাকাত নেই। জাকাত দিতে হয় প্রতি বছর মোট জাকাতযোগ্য (নিসাব) সম্পদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি জাকাত বোর্ড আছে। এর বাইরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আর কোনো জাকাত আদায় হয় না। কিন্তু বেসরকারিভাবে জাকাত নেয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে। আর ব্যক্তিগতভাবে জাকাত দেয়ার রেওয়াজই এখানে বেশি। ১৯৮২ সাল থেকে আইনের অধীনে জাকাত বোর্ড কাজ করছে। তারা জাকাত ফান্ডে জাকাতের অর্থ নেয়।

জাকাত ফান্ডের উপ-পরিচালক মো. আবুল কাসেম জানান, চলতি বছরে তাদের জাকাত ফান্ডে ১১ কোটি টাকা জমা পড়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে বা সরাসরি ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গিয়ে জাকাতের টাকা জমা দেয়া যায়। গরিব মানুষের মধ্যে জাকাত বিতরণ হয় নির্ধারিত ফর্মে আবেদনের ভিত্তিতে।

তিনি বলেন, জাকাত হলো গরিবের হক। এটা কোনো অনুদান বা করুণা নয়। আমরা প্রকৃত বিত্তহীন মুসলমানদের বাছাই করে জাকাত দিই। এছাড়া জাকাতের অর্থে গরিব মানুষের জন্য তাদের সাবলম্বী করার কিছু প্রকল্প এবং টঙ্গীতে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পরিচলনা করা হয়।

জাকাত হিসাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে সেলাই মেশিন ও রিকশা, ভ্যান দেয়া হয়। নগদ টাকাও দেয়া হয়। এছাড়াও গরিব পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা ভাতা দেয়া হয়। নগদ টাকাও দেয়া হয়। এটা সর্বনিম্ন সাত হাজার টাকা আর সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা । এই জাকাতের টাকায় সারাদেশের ৩৪ জেলায় একটি করে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করা হয় বিনামূল্যে। প্রতি ব্যাচ থেকে তিন জনকে সেলাই মেশিন দেয়া হয়।

তিনি জানান, প্রতিবছর ৮০ হাজারের মতো জাকাত নেয়ার আবেদন আসে। গড়ে ৫০ হাজারের মতো ব্যাক্তিকে প্রতি বছর জাকাত ফান্ড থেকে সহায়তা করা হয়।

তিনি বলেন, এখন জাকাত ফান্ডে জাকাত দেয়ার আগ্রহ বাড়ছে। শুরুতে বছরে এক কোটি টাকাও পাওয়া যেতো না। অনলাইনে আমাদের জাকাত ক্যালকুলেটর আছে। সেখান থেকেই যে কেউ তার জাকাতের হিসাব করতে পারেন। আর নগদ বা সোনালী ব্যাংকের যে-কোনো শাখায় জাকাতের টাকা জমা দেয়া যায়।

কিন্তু সরকারের জাকাত ফান্ডে জমা পড়া এই অর্থ বাংলাদেশে জাকাতের অর্থের যে সম্ভাবনা আছে, তার অতি সামান্যই।

বাংলাদেশের জাকাতের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এমরানুল হক। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের কিছু অর্থনীতিবিদ জাকাতের সম্ভাবনার হিসাব করে দেখিয়েছিলেন। সেটা ছিল তখনকার জিডিপির ৩.৭৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেটা ধরে আমি একটা গবেষণা করি। তাতে জিডিপি বিবেচনায় আমার হিসাবে বছরে ১৯০ হাজার কোটি টাকারও ওপরে জাকাত কালেকশন করা সম্ভব। সেখানে আমাদের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হলো ১৩ হাজার কোটি টাকা। আর তার উপকারভোগী এক কোটি নিম্নবিত্ত মানুষ।

তিনি এই হিসাব করেছেন ব্যক্তি ধরে নয়। মানুষের ব্যাংকে জমানো টাকা ও সম্পদ ধরে। কৃষি সম্পদসহ আরও যেসব ব্যাংকিং টুলস আছে সেগুলো ধরে। আর শুধু ব্যক্তি নয়, কর্পোরেট জাকাতও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ‘জাকাত ফেয়ার’ অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের জাকাত দিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং গরিব মানুষের কল্যাণে এই জাকাতের টাকা ব্যবহারের বিভিন্ন মডেল উপস্থাপন। মেলার আয়োজন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেডএম) । সেখানে এক সেমিনারে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায় করা সম্ভব। মানুষকে জাকাত আদায়ে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হলে ১০ বছরের মধ্যে এ দেশে ভিক্ষা করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশর সামর্থ্যবান মুসলমানরা বছরে মোট কত টাকা জাকাত দেন, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে তা বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা হবে বলে জানান সিজেডএম-এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক ওয়েছ খান নূর সোহেল। তিনি বলেন, গত বছর আমরা ৫০০ কোটি টাকার জাকাত সংগ্রহ করেছি। আমরা ছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত সংগ্রহ করে। আর ব্যক্তি পর্যায়েও অনেক জাকাত দেয়া হয়। আমি জাকাত সংগ্রহকারী বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে কত জাকাত দেয়া হয় তারা ধারণা করেছি।

সিজেডএম বাংলাদেশে নিবন্ধিত জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। তারা জাকাত আদায়ই শুধু নয়, এর ব্যবস্থাপনা নিয়েও কাজ করে। কীভাবে জাকাত আদায় বাড়ানো যায় এবং সঠিকভাবে মানুষকে স্বাবলম্বী করার জন্য বিতরণ করা যায়, তা নিয়ে তাদের মডেল প্রজেক্টও আছে।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, আটটি ক্ষেত্রে জাকাতের অর্থ খরচ করা যায়। ১. ফকির ( ভিক্ষুক) ২. মিসকিন (অভাবগ্রস্ত) ৩. জাকাত আদায় ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা ৪. অমুসলিম (ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য) ৫. দাস মুক্তি ৬. ঋণগ্রস্ত ৭. আল্লাহর রাস্তায় ৮. বিপদগ্রস্ত মুসাফির।

ওয়েছ খান নূর সোহেল বলেন, জাকাতের নামে লাইন দিয়ে শাড়ি বা লুঙ্গি দেয়া বা দান খয়রাত করা ইসলামের আদর্শের সঙ্গে যায় না। ইসলাম ব্যক্তির আত্মমর্যাদাকে খুব গুরুত্ব দেয়। জাকাত হলো গরিবের হক বা অধিকার। ফলে গরিবের হক তার প্রয়োজন মতো দিতে হবে। প্রতি বছর একজনকে একটি করে শাড়ি দিলে তার অভাব কি পুরণ হবে? দেখা যাবে তার শাড়ির প্রয়োজন নাই। আসলে গরিবকে সাবলম্বী করার জন্যই জাকাত দেয়া উচিত।

হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানি বলেন, আসলে দেশে যেসব বিত্তবান মুসলমান, যাদের জাকাত ফরজ তাদের বড় একটি অংশ জাকাত দেন না। আবার ইসলামের নিয়ম মেনে যে পরিমাণ জাকাত দেয়া দরকার, সেই পরিমাণও দেন না। অনেকেই জাকাত দেন শড়ি, লুঙ্গি। এগুলো লোক দেখানো। কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেন। মেম্বার, চেয়ারম্যান এমপি হওয়ার জন্য। ফলে জাকাতের সুফল পাওয়া যায় না। অথবা জাকাতের আসল লক্ষ্য অর্জিত হয় না। যদি গরিবের হক হিসাবে জাকাত দেয়া হতো, তাহলে আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশে কয়েক বছর পর জাকাত নেয়ার মতো লোক থাকতো না।

তার কথা, এখানে যারা জাকাত দেন, তাদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাকাত দেন। কারণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের আস্থা নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের কাজ করে। কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আস্থা অর্জন করছে। ইসলামী রাষ্ট্র না হওয়ায় ফরজ হলেও এখানে মুসলানদের জাকাত দিতে বাধ্য করা যাচ্ছে না। তবে সেটা না হলেও ফরজ হিসাবে সামর্থ্যবান মুসলমানের সঠিক পরিমাণে জাকাত দিতে হবে। না দিলে সে গুণাহগার হবে।

নাগরিকরা সরকারকে প্রতিবছর যে আয়কর দেন, তার সঙ্গে জাকাতের পার্থক্য আছে। আয়কর দিতে হয় বর্ধিত আয়ের ওপর। যে আয়ের ওপর একবার কর দেয়া হয়েছে, সেই আয়ের ওপর আর কর দিতে হয় না। কিন্তু মুসলমানদের নির্ধারিত (নিসাব) পরিমাণ সম্পদ থাকলেই প্রতিবছর জাকাত দিতে হবে। আর সরকারকে আয়কর দিলে ইসলামে জাকাত মাফ হবে না। আয়কর দিলেও জাকাত দিতে হবে বলে জানান মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী।

ওয়েছ খান নূর সোহেল বলেন, আমরা ধারণা করি, দেশে পাঁচ কোটি মুসলমান জাকাত দেয়ার যোগ্য। তারা সবাই জাকাত দিলে দারিদ্র্য দূর করা অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা। দান খয়রাত বিবেচনায় জাকাত দিলে হবে না। গরিব মানুষকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে, তাদের সন্তানদের পড়া-লেখা, চিকিৎসাসহ আরো অনেক খাতে ইসলামের নিয়ম মেনে জাকাত দেয়া যায়। আর সেই পরিকল্পনা রাষ্ট্রীয়ভাবেও হতে পারে।

আর অধ্যাপক ড. এম এমরানুল হক বলেন, আমরা বাজেটে যে অর্থ ব্যয় করি দারিদ্র্য বিমোচনে এক বছরে তার চৌদ্দগুণ বেশি অর্থ এক বছরের জাকাত থেকে আসতে পারে। আর জাকাতের অর্থ ফেরত দিতে হয় না। এরজন্য সুদ দিতে হয় না। কিন্তু বাজেটে যে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা নেয়া হয়, তা সুদে-আসলে ফেরত দিতে হয়। তাই দারিদ্র্য দূর করতে জাকাত একটি বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। এই খাতকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা।

“সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির কারণে যেহেতু মানুষের আস্থার জায়গায় নেই, তাই দেশের শীর্ষ আলেম ও ইসলামী চিন্তবিদদের সমন্বয়ে জাতীয় শরিয়াহ বোর্ড করে তাদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে জাকাত আদায় ও বিতরণ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয়া যায়,” বলেন মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানি। তার কথা, ধনীদের সম্পদের ওপর গরিবের হক আছে। এটা সমাজে ভারসাম্য তৈরি করে। আর সেটা যদি আদায় না করা হয়, তাহলে সমাজে ভারসাম্য তৈরি হবে না।