ঢাকা , মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আ.লীগের দাপুটে আমলারা কোথায়

  • মো. শাহজাহান
  • আপডেট সময় ০৬:৩২:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫
  • ৮০ বার পড়া হয়েছে

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি আমলাদের দাপুটে তটস্থ ছিল অনেক মন্ত্রীও। গণভবনের আশির্বাদপুষ্ট এসব আমলারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাট করেছে দেশের বিপুল পরিমান অর্থ। তারা এখন কোথায়? এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সাধারণ জনমনে। দুদক এসব আমলাদের ফাইল টেবিলে উঠালেও রহস্যজনক কারণে তা আবার চলে যায় আন্ডার টেবিলে।

সম্প্রতি এসব আমলাদের লুটপাটের একটি শ্বেতপত্র তুলে ধরেছে শ্বেতপত্র কমিটি। এতে বলা হয় বিনিয়োগকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য যেসব পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে, এ সময় তাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে ঘুষ হিসেবেই চলে গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুষ নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাঁদের সহযোগী ব্যক্তিরা।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুষের টাকার মধ্যে ৭৭ হাজার থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা গেছে আমলাদের কাছে। আর রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের সহযোগী ব্যক্তিদের কাছে গেছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা গেছে তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে। ঘুষের বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে নগদ অর্থে কিংবা অন্য কোনো জিনিস উপঢৌকন হিসেবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে যেসব আমলা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবদের সম্পদের তথ্য তলবের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এই প্রক্রিয়া। এরপর তদন্তের আওতায় আসবেন সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ও জ্বালানি সচিবরা। এর বাইরে আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী বেশ কয়েকজন আমলার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, গত সরকারের সময়ে কয়েক ডজন প্রভাবশালী আমলার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অনিয়ম ও  দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। এরমধ্যে কয়েকজনের অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক। চাকরি জীবনে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। এসব অবৈধ অর্থে তারা দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। কারও কারও রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার।

দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে দুদকে ফাইলবন্দি ছিল। সরকারে ওপর মহলের চাপে তাদের বিষয়ে কোনো কাজ করা যায়নি। ক্ষমতার পালাবদলে সেসব ফাইল নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে দুদক। এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমে সব অভিযোগ নিয়ে কাজ করা হবে বলে জানান দুদক সুত্র।

অনুসন্ধানের তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার,খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, মোহাম্মদ শফিউল আলম, মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া এবং এম আবদুল আজিজ। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবদের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ড. আহমদ কায়কাউস, মো. নজিবুর রহমান, ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, মো. আবুল কালাম আজাদ, আবদুস সোবাহান সিকদার, শেখ মো. ওয়াহিদ উজ্জামান এবং এম আব্দুল আজিজের সম্পদের খোঁজে নামবে দুদক।

তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। সাবেক এই আমলার ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ও পরিবারের নামে জ্ঞাত   আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে।  গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রচণ্ড প্রভাবশালী এই আমলার ভয়ে তটস্থ থাকতেন অধীনস্থরা। প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ,সেন্টমার্টিনের সোনাদিয়া, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ।

এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দেশের বাইরে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। কানাডার বেগমপাড়ায় তিনটি বাড়িসহ বিপুল পরিমাণে অর্থ রয়েছে। কবির বিন আনোয়ার তার ৫ বোন ও বোনের স্বামীদের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়েছে অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নজিরবিহীন দুর্নীতি আর অনিয়মে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যুতের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকা হাতান তিনি।

এ ছাড়া মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বদলি-পদায়ন ও পছন্দের ঠিকাদারদের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দিতে তদবির বাণিজ্য করেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি আর অনিয়মের একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। এই সচিবের সময়ে পদ্মা সেতুসহ  দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।

এসব প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কিছু সংখ্যক আমলা ও প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা মিলে লুটপাটের রামরাজত্ব তৈরি করেছিল। যারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।

এই লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক গণপূর্ত সচিব ড. খন্দকার শওকত হোসেন,শহীদুল্লাহ খন্দকার ও ওয়াসি উদ্দিন। যার মধ্যে দু’জনই গোপালগঞ্জে এবং একজন শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেনের বেয়াই। মূলত: গোপালী সিন্ডিকেট অনিয়ম, দুর্নীতি, টেন্ডার বাণিজ্য, প্লট বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করে পুরো মন্ত্রণালয়কে ও অধিদপ্তরগুলোকে ফোকলা করে দিয়েছে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিস্বেরের নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন আব্দুল মান্নান খান। তার বেশুমার দুর্নীতি ও তার ক্যাশিয়ার ইকবালের কারনে অনিয়ম ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় মন্ত্রণালয়টি। এরমধ্যে এ্যাডভোকেট ইকবালকে রাজউকের উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে শত শত কোটি টাকার প্লট বাণিজ্য করেন। যার সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হুদা।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাকে কেন্দ্র করে নতুন সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। তাঁর সময়েই চার চারজন প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ দেয়া হয় গণপূর্ত অধিদপ্তরে। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের শেষ দিনেও অর্ধশত কোটি টাকা
নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ দিয়ে রেকর্ড গড়েন। এ সময়ে চুয়েট ছাত্রলীগ নেতা ও চট্টগ্রামের বাসিন্দা শওকত উল্লাহ ও উৎপল কুমার দে’র নেতৃত্বে দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী চক্র গড়ে ওঠে। যাতে প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত মো. ফজলুল হক মধুসহ একটি চক্রের যোগসাজসে টেন্ডার ও বদলি বাণিজ্যে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় গণপূর্ত অধিদপ্তর।

৭ বছর সচিবের দায়িত্ব পালনের পর শহীদুল্লাহ খন্দকারের চুক্তির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে গোপালগঞ্জের আরেক অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিনকে পূর্ত সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরও এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের র্দুর্ধষ ক্যাডার কাজী ওয়াসি উদ্দিন নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করতেন না। তিনি সচিব পদে বসেই একের পর এক বদলি, প্লট কেলেঙ্কারি আর আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বাদ যায়নি তার বাসা ভাড়া নিয়ে কেলেঙ্কারিও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদের বাড়ির সামনে কাশিপুর খালের ওপর সাড়ে আট কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ৯৬ মিটার দৈর্ঘ্যর একটি গার্ডার সেতু। নির্মাণাধীন সেতুর পশ্চিম প্রান্ত সাবেক সচিবের বাড়ির প্রবেশদ্বার হলেও পূর্ব প্রান্তে জনগুরুত্বহীন একটি সড়ক।

সূত্রমতে ২০২০-২১ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর আয়রন ব্রিজ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালীতে একাধিক সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত আটটি সেতু বাস্তবায়ন এলাকা নির্বাচিত হয় ফয়েজ আহম্মদের নিজ গ্রামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয়রন ব্রিজ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও পটুয়াখালী এলজিইডিকে প্রভাবিত করে নিজ এলাকায় এসব প্রকল্প বাগিয়েছেন তিনি।

দুদকের মহাপরিচালক মীর মোঃ জয়নুল আবেদীন শিবলী এ প্রতিবেদককে বলেন, দুদকে অনুসন্ধান চলমান। শীর্ষ আমলারা যারা বিগত সরকারের আমলে অনেক প্রভাবশালী ছিল ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তারা তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা হয়েছে। খুব শিগগিরই সাবেক এই আমলাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

আ.লীগের দাপুটে আমলারা কোথায়

আপডেট সময় ০৬:৩২:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি আমলাদের দাপুটে তটস্থ ছিল অনেক মন্ত্রীও। গণভবনের আশির্বাদপুষ্ট এসব আমলারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাট করেছে দেশের বিপুল পরিমান অর্থ। তারা এখন কোথায়? এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সাধারণ জনমনে। দুদক এসব আমলাদের ফাইল টেবিলে উঠালেও রহস্যজনক কারণে তা আবার চলে যায় আন্ডার টেবিলে।

সম্প্রতি এসব আমলাদের লুটপাটের একটি শ্বেতপত্র তুলে ধরেছে শ্বেতপত্র কমিটি। এতে বলা হয় বিনিয়োগকে ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য যেসব পণ্য ও সেবা কেনা হয়েছে, এ সময় তাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে ঘুষ হিসেবেই চলে গেছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ঘুষ নিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও তাঁদের সহযোগী ব্যক্তিরা।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুষের টাকার মধ্যে ৭৭ হাজার থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা গেছে আমলাদের কাছে। আর রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের সহযোগী ব্যক্তিদের কাছে গেছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা গেছে তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ চক্রের কাছে। ঘুষের বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে নগদ অর্থে কিংবা অন্য কোনো জিনিস উপঢৌকন হিসেবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে যেসব আমলা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবদের সম্পদের তথ্য তলবের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এই প্রক্রিয়া। এরপর তদন্তের আওতায় আসবেন সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ও জ্বালানি সচিবরা। এর বাইরে আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী বেশ কয়েকজন আমলার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, গত সরকারের সময়ে কয়েক ডজন প্রভাবশালী আমলার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অনিয়ম ও  দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। এরমধ্যে কয়েকজনের অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক। চাকরি জীবনে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা। এসব অবৈধ অর্থে তারা দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। কারও কারও রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার।

দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে দুদকে ফাইলবন্দি ছিল। সরকারে ওপর মহলের চাপে তাদের বিষয়ে কোনো কাজ করা যায়নি। ক্ষমতার পালাবদলে সেসব ফাইল নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে দুদক। এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমে সব অভিযোগ নিয়ে কাজ করা হবে বলে জানান দুদক সুত্র।

অনুসন্ধানের তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার,খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, মোহাম্মদ শফিউল আলম, মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া এবং এম আবদুল আজিজ। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবদের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ড. আহমদ কায়কাউস, মো. নজিবুর রহমান, ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, মো. আবুল কালাম আজাদ, আবদুস সোবাহান সিকদার, শেখ মো. ওয়াহিদ উজ্জামান এবং এম আব্দুল আজিজের সম্পদের খোঁজে নামবে দুদক।

তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। সাবেক এই আমলার ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ও পরিবারের নামে জ্ঞাত   আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে।  গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রচণ্ড প্রভাবশালী এই আমলার ভয়ে তটস্থ থাকতেন অধীনস্থরা। প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ,সেন্টমার্টিনের সোনাদিয়া, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ।

এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দেশের বাইরে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। কানাডার বেগমপাড়ায় তিনটি বাড়িসহ বিপুল পরিমাণে অর্থ রয়েছে। কবির বিন আনোয়ার তার ৫ বোন ও বোনের স্বামীদের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়েছে অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নজিরবিহীন দুর্নীতি আর অনিয়মে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যুতের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকা হাতান তিনি।

এ ছাড়া মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বদলি-পদায়ন ও পছন্দের ঠিকাদারদের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দিতে তদবির বাণিজ্য করেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি আর অনিয়মের একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে দুদকে। এই সচিবের সময়ে পদ্মা সেতুসহ  দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।

এসব প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কিছু সংখ্যক আমলা ও প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা মিলে লুটপাটের রামরাজত্ব তৈরি করেছিল। যারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।

এই লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক গণপূর্ত সচিব ড. খন্দকার শওকত হোসেন,শহীদুল্লাহ খন্দকার ও ওয়াসি উদ্দিন। যার মধ্যে দু’জনই গোপালগঞ্জে এবং একজন শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেনের বেয়াই। মূলত: গোপালী সিন্ডিকেট অনিয়ম, দুর্নীতি, টেন্ডার বাণিজ্য, প্লট বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করে পুরো মন্ত্রণালয়কে ও অধিদপ্তরগুলোকে ফোকলা করে দিয়েছে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিস্বেরের নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন আব্দুল মান্নান খান। তার বেশুমার দুর্নীতি ও তার ক্যাশিয়ার ইকবালের কারনে অনিয়ম ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় মন্ত্রণালয়টি। এরমধ্যে এ্যাডভোকেট ইকবালকে রাজউকের উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে শত শত কোটি টাকার প্লট বাণিজ্য করেন। যার সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হুদা।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাকে কেন্দ্র করে নতুন সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। তাঁর সময়েই চার চারজন প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ দেয়া হয় গণপূর্ত অধিদপ্তরে। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের শেষ দিনেও অর্ধশত কোটি টাকা
নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ দিয়ে রেকর্ড গড়েন। এ সময়ে চুয়েট ছাত্রলীগ নেতা ও চট্টগ্রামের বাসিন্দা শওকত উল্লাহ ও উৎপল কুমার দে’র নেতৃত্বে দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী চক্র গড়ে ওঠে। যাতে প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলামের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত মো. ফজলুল হক মধুসহ একটি চক্রের যোগসাজসে টেন্ডার ও বদলি বাণিজ্যে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় গণপূর্ত অধিদপ্তর।

৭ বছর সচিবের দায়িত্ব পালনের পর শহীদুল্লাহ খন্দকারের চুক্তির মেয়াদ আর না বাড়িয়ে গোপালগঞ্জের আরেক অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিনকে পূর্ত সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরও এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের র্দুর্ধষ ক্যাডার কাজী ওয়াসি উদ্দিন নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করতেন না। তিনি সচিব পদে বসেই একের পর এক বদলি, প্লট কেলেঙ্কারি আর আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বাদ যায়নি তার বাসা ভাড়া নিয়ে কেলেঙ্কারিও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদের বাড়ির সামনে কাশিপুর খালের ওপর সাড়ে আট কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ৯৬ মিটার দৈর্ঘ্যর একটি গার্ডার সেতু। নির্মাণাধীন সেতুর পশ্চিম প্রান্ত সাবেক সচিবের বাড়ির প্রবেশদ্বার হলেও পূর্ব প্রান্তে জনগুরুত্বহীন একটি সড়ক।

সূত্রমতে ২০২০-২১ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর আয়রন ব্রিজ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালীতে একাধিক সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত আটটি সেতু বাস্তবায়ন এলাকা নির্বাচিত হয় ফয়েজ আহম্মদের নিজ গ্রামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আয়রন ব্রিজ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও পটুয়াখালী এলজিইডিকে প্রভাবিত করে নিজ এলাকায় এসব প্রকল্প বাগিয়েছেন তিনি।

দুদকের মহাপরিচালক মীর মোঃ জয়নুল আবেদীন শিবলী এ প্রতিবেদককে বলেন, দুদকে অনুসন্ধান চলমান। শীর্ষ আমলারা যারা বিগত সরকারের আমলে অনেক প্রভাবশালী ছিল ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তারা তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা হয়েছে। খুব শিগগিরই সাবেক এই আমলাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হবে।