আমি তখন ছোট। গ্রামে জন্ম তাই ওখানেই বেড়ে উঠা। বাড়ি থেকে দূই মাইল দূরে প্রাইমারি স্কুল। ছোট আপুর সাথে পাড়ার সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে সবে যাওয়া আসা শুরু। স্কুল মানে তখন রাস্তায় বড়ই গাছে ঢিল, বেতফল তুলে আনা, লাঙল গোটা ছিঁড়ে আনা, ছন খেত থেকে বাতাকালি তুলে এনে পেঁয়াজ কাচা মরিচে মাখিয়ে খাওয়া, ডেওয়া গাছে উঠে পাকা ডেওয়া পেড়ে বন্ধুদের নিয়ে ভাগাভাগি করে খাওয়া, অর বরই গাছে ঝুলে থাকতো পাকা হলেদ অরবরই, ঢিল দিতেই দৌড়ে আগে যেতেন পিঠ কুঁজো হয়ে যাওয়া বুড়ি বিন্তি মাসী, বকা দিতেন, “কোন গোলামের পুতরে, গাছো ইঁডা (ঢিল) মারতাছে, তরার বাপ মায়ে হাতে গুতে অরবরই খাওয়াছেনা তরারে? খাড়ো, আইতাছি লাডিডা কই…।
আমাদের আর পায় কে? দে দৌড়। লাফ দিয়ে গাছের নিচে পাটখেতে পড়ে আর চিন্তা নেই। কিছুক্ষণ দৌড়ে সুতার পাড়ায় এসে ধীরেন কাকার বড় কুয়া বা ইঁদারায় পানি খেতে বালতি ফেলতেই কাকি চিৎকার করে বলতো, “কেডা রে, বালতিডা যে পড়েনা রশি ছিঁইড়া, সাবধানে কইলাম।
হাফপেন্টের দুই পকেট ভর্তি থাকতো আমের কড়া মানে অপরিপক্ষ আম, সাথে ছিনাই বা পুকুরে পাওয়া ঝিনুক, যা দিয়ে আম ছিলতাম। সবাইেক বিলিয়ে দিয়ে মজা করে খেতাম।
আমাদের পুকুরে ছিনাই পাওয়া যেতো, তুলে এনে রোদে শুকায়ে দালানে ঘষে ধারালো করে নিতাম। যা দিয়ে আম ছিলা ও কাটা দুটোই হতো। ছুটির পর হেড মাষ্টার আবদুর রহিম স্যার আমাদের সব পোলাপান কে স্কুলের মাঠের কোণে কাঁঠাল গাছের নিচে দাড় করিয়ে “আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম গাছের মউ” বলতেন। আমরা সাথে সাথে বলে যেতাম।
একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি নীরব সব। ক্লাস নাই। স্যারকে জিজ্ঞেস করলে বল্লেন, আইজ “মে দিবস”, স্কুল বন্ধ, ক্লাস অইেবা না, বাইত যাওগা।
কিসের মে দিবস, কেন, এটা কি? তা জানার প্রয়োজন মনে করতাম না। স্কুল বন্ধ, এটাই বড় পাওয়া। দল বেঁধে তাইের নাইের করে বাড়িতে চলে আসি। বাড়ির উঠানে লিছু গাছ তলায় চেয়ারে বসে থাকতেন আব্বা। আমাদের ডাকেন, কি হলো, স্কুল থেকে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলি কেনো?
মে দিবসের বন্ধ স্কুল আব্বা। ছোট আপা বলেন।
মে দিবস কি বুঝোস? -আব্বা আমাদের জিজ্ঞেস করতেন। আমরা চুপ করে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতাম।
আব্বা বলতেন, তোদের টিচারকে জিজ্ঞেস করার দরকার ছিলো। শোন বলছি।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকরা দৈনক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে সমাবেশ করে। তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে রাখে পুলিশ। কে বা কাহারা পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়ে। শুরু হয় শ্রমিকদের উপর পুলিশের গুলি। তাতে দশ থেকে বারো জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়।
১৮৯১ সালে প্যারিসে আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহিত হয়, স্বীকৃতি পায় মে দিবস।
১৯০৪ সালে আমস্টারডাম সমাজতন্ত্রীদের সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে দেশে মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। আব্বার কাছে ছোটবেলায় শোনা মে দিবসের কথা ভুলিনি কোনদিন।