১৯৭৪ সালের মার্চ মাসের ১৫ তারিখে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার পূর্ব কূয়ালী গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্য গ্রহণ করেন কাজী সিরাজুল ইসলাম। সেই গ্রামেরই মাটি, ঘাস, খাল-বিল, নদী-নালার সাথে সখ্যতা করেই তার বেড়ে ওঠা। ভোরবেলা বাড়ির পাশের মসজিদের মক্তবে ছেলে মেয়ে সবাই মিলে একসাথে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে ইসলাম শিক্ষা নেওয়া যেন ছিলো প্রতিদিনের রুটিন। তারপর সকালের নাস্তা সেরে দল বেঁধে সহপাঠীদের সাথে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসে যেয়ে হাজির হওয়া।
স্কুল শেষে বন্ধুরা মিলে একসাথে খেলাধুলা, কখনো মাছ ধরা, বাড়ির পাশের নদীতে দাপাদাপি-ঝাঁপাঝাঁপি করে মোটামুটি আনন্দের মধ্য দিয়েই কাটছিলো জীবন। কিন্তু সেই আনন্দ যেন বেশি সময় স্থায়ী হলো না। চার ভাইকে নিয়ে গরীব বাবা-মায়ের যেখানে সংসার চালানো খুবই কষ্টের, সেখানে পড়ালেখা করা যেন বিলাসিতা। অভাব নামের এই শক্ত চাপে ক্লাস এইটে এসে থেমে গেল সিরাজুলের পড়ালেখা। ওই বয়সেই ছোট্ট হাতে শক্ত করে বাবার সাথে ধরলেন সংসারের হাল। ক্ষেতে খামারে, বাজার ঘাটে চলছিল তার কর্মময় জীবন। শত কষ্টের পরেও অভাব যেন কোনভাবেই কাটছিলো না।
২০০২ সালে চিরচেনা গ্রাম রেখে একটু সুখের আশায় পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। এখানে এসে পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে প্রথমেই কাজ করেন নির্মাণ শ্রমিকের। রাতে মেসের ছোট্ট রুমে অনেকগুলো লোক একসাথে গাদাগাদি করে থাকা ও দিনের বেলায় ইট, বালু, সিমেন্টের সাথেই কেটে যাচ্ছিল জীবন। এ থেকে একটু উন্নত জীবনের আশায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ বাদ দিয়ে নিজেকে দাঁড় করান গার্মেন্টস কর্মীর কাতারে। সেখানেই পরিচয় হয় রাজিয়া সুলতানার সাথে। প্রথমে অফিস সহকর্মী পরে প্রেমের সম্পর্ক। দিনে দিনে বাড়তে থাকে প্রেমের গভীরতা। কয়েক বছর পরে সেই প্রেম পূর্ণতা পায় বিয়েতে।
কথাগুলো বলার সময় চোখের পানি টলমল করছিল সিরাজুলের। তিনি বলেন, সেই বিয়ের দিন থেকেই আমার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা আমার সাথে সংসারের হাল ধরেন এবং আজও পর্যন্ত সেই হাল রাজিয়া ছাড়েনি।
বিয়ের দু’বছরের মাথায় তাদের ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসেন তাদের বড় সন্তান কাজী রাজিম ইসলাম। স্বামী-স্ত্রী দুজনই স্বপ্ন দেখেন ছেলেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে। সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে দুজন মিলে দিন রাত একত্র করে করেছেন কঠোর পরিশ্রম। সেদিনের সেই ছোট্ট রাজিম মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাশ করেছেন। সেই সাথে সিরাজুল এর ছোট ছেলে জুবায়ের ইসলাম খিলগাঁও এর একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসার ছাত্র।
অশ্রু জ্বলজ্বল চোখে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ছেলে ২ টাকে কখনোই তাদের মনের মত কিছু দিতে পারিনি। তবে ছেলেদেরও খুব বেশি চাহিদা নেই। যখন যেভাবে রাখতে পেরেছি ওভাবেই তারা মানিয়ে নিয়েছে। খুব বেশি কষ্ট লাগে আমার বউটার জন্য, সেই বিয়ের দিন থেকেই মেয়েটা আমার সাথে জীবনযুদ্ধে আমার সহযোদ্ধা হয়ে আছে। তাকেও আমি কখনো ভালো কিছু দিতে পারিনি, ভালো রাখতে পারিনি। মাঝেমধ্যে মনে হয় গরিব হয়ে জন্ম নেওয়াটাই অপরাধ।
কথাগুলো বলতে বলতে অজান্তেই চোখের পানি গাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো সিরাজুল ইসলামের।
গার্মেন্টস এর কাজ ছাড়ার পরে সিরাজুল কাজ করেছেন বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন জায়গায়। বর্তমানে কাজ করছেন রাজধানীর খিলগাঁও এর একটি গরুর ফার্মে।
বর্তমান কর্মস্থল নিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি যে ফার্মে কাজ করছি এখানকার মালিক এবং তার পরিবারের লোকজন গুলো খুবই ভালো মানুষ। আমরা যারা এখানে কাজ করি আমাদের সবার সাথেই মালিকের আচার আচরণও খুবই ভালো। তবে বেতন একটু কম। যেই টাকা বেতন পাই তার বেশিরভাগ চলে যায় বাসা ভাড়া দিতেই। আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় সন্তানদের নিয়ে এই শহরে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনরকম কেটে যাচ্ছে জীবন।
তিনি বলেন, হয়তো গরিব ঘরে জন্মানোতেই জীবনে সুখের মুখ দেখতে পাইনি। তবে আমি চাইনা আমার সন্তানদের জীবনও আমার মত হোক। আমি চাই ওরা পড়াশোনা করে মানুষের মত মানুষ হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে জীবন যাপন করুক। আমি আমার সন্তানদের জন্য সকলের কাছে দোয়া চাই।