যে কোনো সময় পাকিস্তানে ছোট থেকে মাঝারি ধরনের ভারতীয় সামরিক পদক্ষেপ প্রায় আসন্ন ছিল। গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশি রাষ্ট্র পাকিস্তানকে দায়ী করে হামলার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল ভারত। দেশটির হামলার পরিকল্পনার আগাম খবর দিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দারা।
বিশ্লেষকরাও নিশ্চিত ছিলেন, মুখরক্ষার জন্য হলেও সামরিক অভিযান চালাবে ভারত। অবশেষে তা-ই হলো। পারমাণমিক শক্তিধর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই পাকিস্তানের বেশ অভ্যন্তরে তিন বাহিনীর যৌথ হামলা চালাল ভারত। পাল্টা জবাব দিয়েছে পাকিস্তানও। এসবের মধ্যে দিয়ে দু দেশই এসে দাঁড়াল যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে।
বিবিসি, আল জাজিরা ও রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দিবাগত রাত একটার কিছু সময় আগে শুরু হয় ভারতীয় সিরিজ হামলা ‘অপারেশন সিন্দুর’। ভারত জানিয়েছে, তারা পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড ও দেশটির নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। গভীর রাতে বিশাল বিস্ফোরণে বাসিন্দারা জেগে উঠেন।
পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের নয়টি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। পাকিস্তানের স্বীকার করা ছয়টি স্থান হলো- পাঞ্জাবের শিয়ালকোট, ভাওয়ালপুর ও মুরিদকে এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফারাবাদ, বাগ ও কোটলি শহর। এসব অঞ্চলে একের পর এক ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। ভারতের সেনাবাহিনী বলেছে, তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কোনো স্থাপনায় হামলা চালায়নি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পিটিআই জানিয়েছে, ভাওয়ালপুরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক চিহ্নিত সন্ত্রাসী সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ-ই-মোহাম্মদের প্রধান কার্যালয় এবং মুরিদকে শহরে আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী লস্কর-ই-তাইয়েবার প্রধান কার্যালয়সহ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আস্তানায় এসব হামলা চালিয়েছে। তবে তাদের এ দাবিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পাকিস্তান বলেছে, ভারত বেসামরিক মানুষের ওপর কাপুরুষোচিত হামলা চালিয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান জানিয়েছে, তাদের ছয়টি স্থানে আক্রমণ করা হয়েছে এবং এর জেরে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সের তৈরি তিনটি রাফাল, একটি রাশিয়ার তৈরি সু-৩০এমকেআই ও একটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান। সু-৩০ ও মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান সোভিয়েত আমলে তৈরি।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ভারত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
তবে গতকাল ভারতের পাঞ্জাবের বাথিন্দা জেলার আকলিয়া কালান গ্রামের গম ক্ষেতে একটি অজ্ঞাত বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে ভারতীয় বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার। এ ঘটনায় একজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়। বুধবার রাত দেড়টার দিকে, ভারত অপারেশন সিন্দুর শুরুর পরপরই এ ঘটনা ঘটে।
এদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সীমান্তে পাকিস্তানি হামলায় কমপক্ষে ১৫ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।
গত মাসে পহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে চলে এল যে, প্রায় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে গেল দুই দেশ। যদিও পূর্ণ পরিসরে অল-আউট যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনো কম বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। ভারতের দাবি পেহেলগাম হামলায় ‘পাকিস্তান-ভিত্তিক বহিরাগত সন্ত্রাসীদের স্পষ্ট জড়িত থাকার প্রমাণ’ রয়েছে। তবে পাকিস্তান কোনো যোগসূত্র অস্বীকার করেছে।
পাকিস্তান বলেছে, জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদের আওতায় তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। দেশটি হুঁশিয়ার করে বলেছে, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন ও বেসামরিক লোকজনকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে সময়মতো ভারতের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে তারা।
গতকাল পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, নিজেদের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভারতের হামলাকে ‘উসকানিমূলক ও কাপুরুষোচিত’ উল্লেখ করে ইসলামাবাদ বলেছে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের আগ্রাসন থেকে নিজ দেশের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করেছে।
এদিকে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ এবং পাঞ্জাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদে আঘাত হেনেছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। তাদের মধ্যে মুজাফফরাবাদের বাসিন্দা মুহাম্মদ ওয়াহিদ ও পাঞ্জাব প্রদেশের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইউনিস শাহের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।
মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময়ের বর্ণনা দিয়ে দিয়ে তিনি জানান, মুজাফফরাবাদে ওয়াহিদের বাড়ি যেখানে, তার পাশেই বিলাল মসজিদ। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘প্রথমবারের বিস্ফোরণে আমার বাড়ি যখন কেঁপে ওঠে, তখন আমি গভীর ঘুমে। আমি দৌড়ে রাস্তায় বের হই, সেখানে আগেই অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। কী ঘটছে, আমরা সেটা বুঝে ওঠার আগেই আরও তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যার ফলে ওই এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।’
ওয়াহিদ আরও বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, কেন আমাদের স্থানীয় মসজিদে হামলা চালানো হয়েছে। এটি বাড়ির কাছের খুবই সাধারণ একটি মসজিদ ছিল, যেখানে আমরা দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তাম। আমি কখনো এটি ঘিরে কোনো ধরনের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড দেখিনি।’
স্থানীয় লোকজন এখন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানান ওয়াহিদ। তিনি বলেন, চরম অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুরিদকে শহরের বাসিন্দা ইউনিস শাহ বিবিসিকে বলেছেন, ভারতের ছোড়া চারটি ক্ষেপণাস্ত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র পরপর এবং চতুর্থ ক্ষেপণাস্ত্রটি পাঁচ থেকে সাত মিনিট পর আঘাত হানে।
ইউনিস শাহ বলেন, হামলায় সেখানে একটি স্কুল, একটি কলেজ, একটি ছাত্রাবাস, একটি চিকিৎসাকেন্দ্র এবং পাশাপাশি একটি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে একটি আবাসিক এলাকাও আছে, যেখানে কয়েকটি পরিবার বসবাস করত।