বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানের পর জাতি এখন এক অভূতপূর্ব উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে, কিন্তু পথে বাধা হয়ে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থাহীনতা। কেউ চায় দ্রুত নির্বাচন, কেউ চায় বিচার আগে, কেউ আবার সংস্কার ছাড়া কিছুতেই যাবে না—এই অবস্থানগত সংকীর্ণতা সংকটকে দিন দিন জটিল করে তুলছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা স্বৈরাচারী ও দমনমূলক শাসনের প্রতীক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। রাজনৈতিক নিপীড়ন, ভোটাধিকার হরণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের একচেটিয়া ব্যবহার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণবিস্ফোরণ ঘটে। শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী ও পেশাজীবীদের সম্মিলিত নাগরিক আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর মাধ্যমে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান হয়। ড. ইউনুসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধান লক্ষ্য—দেশকে একটি টেকসই, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
এই নতুন যুগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন তিনটি বিষয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ:
(১) পতিত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শক্তির বিচার,
(২) রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার, এবং
(৩) একটি সফল, বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন।
এই তিনটি প্রক্রিয়া আপাতদৃষ্টিতে পৃথক হলেও, মূলত পরস্পর-সম্পর্কিত এবং একটি আরেকটির অনিবার্য ভিত্তি। একটিকে অবহেলা করলে অন্য দুটি ভেঙে পড়বে।
বিচার: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়মুক্তির অবসান
১০ মে ২০২৫-এ বর্তমান সরকার গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা করে—আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম বিচারকার্য সম্পাদন না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ। তার আগে গঠিত হয় মানবাধিকার লঙ্ঘনবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, যার দায়িত্ব জুলাই গনহত্যা,২০০৮–২০২৪ সাল পর্যন্ত সংঘটিত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশি নিপীড়ন ও রাজনৈতিক নিপীড়নের বিচার করা।
এই বিচারব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিচালিত হতে হবে, যেখানে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের পরামর্শে নিয়োগকৃত বিচারপতি, তদন্তকারী এবং আইনজীবীরা যেন সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার মাধ্যমে বিচারকার্য সম্পাদনা করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। লক্ষ্য প্রতিশোধ নয়, বরং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি। বিচারের আওতায় থাকতে হবে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর নির্যাতনকারী কর্মকর্তারা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং রাষ্ট্রীয় পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, রাষ্ট্রীয় সহায়তায় লুটাপাট-পাচারকারী এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগসহ এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনগুলো।
সংস্কার: একটি ভাঙা রাষ্ট্রের পুনর্গঠন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যেই ১৬৬টি সুপারিশ পেশ করেছে। এসব সুপারিশ মূলত সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়া ও নাগরিক অধিকারের মৌলিক সংস্কারকে কেন্দ্র করে গঠিত।
নতুনভাবে গঠিত ‘ঐক্যমত্য কমিশন’ রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে এই সংস্কার প্রস্তাব যাচাই করছে। এতে অংশগ্রহণকারী দলের অবস্থান সংক্ষেপে তুলে ধরা যেতে পারে:
● বিএনপি: ১৬৬টি প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে—যেমন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সংসদের মেয়াদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সময়সীমা, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত সংস্কারে—তারা একমত হতে পারেনি। অথচ এসব বিষয় তাদেরই ঘোষিত ৩১ দফার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত, ফলে এ অবস্থান তাদের নিজের নীতির সাথেই সাংঘর্ষিক। যদিও প্রশাসন, দুর্নীতি দমন, বিচারব্যবস্থা ও গণমাধ্যম সংস্কারসহ অন্যান্য বহু প্রস্তাবে তারা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করেছে, তথাপি একটি পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছাতে হলে ঘোষিত নীতির সঙ্গে তাদের অবস্থানের সঙ্গতি আনা এবং জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে বাস্তবিক নমনীয়তা দেখানো এখন অপরিহার্য।
● রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন (RSA): প্রস্তাবিত ১৬৬ দফার মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ সংস্কারে তারা সমর্থন জানিয়েছে, যা তাদের রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষত স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালীকরণ, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা এবং সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠার মতো প্রস্তাবে তারা কেবল সমর্থন নয়, বরং বাস্তবায়নের কৌশল ও কাঠামোগত দিক নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে। RSA মনে করে, এসব পদক্ষেপ না নিলে শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব নয়। তাদের প্রস্তাবনা রাজনীতির বাইরে থেকে আসা একটি জনমুখী ও যুক্তিনির্ভর সংস্কারধারার প্রতিনিধিত্ব করছে।
● এনসিপি, গণসংহতি, গণঅধিকার পরিষদ, জামায়াত ও অন্যান্য দল: এই দলগুলো প্রস্তাবিত ১৬৬ দফার প্রতিটি বিষয়ে একমত না হলেও, সামগ্রিকভাবে তারা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা স্বীকার করেছে। তাদের আপত্তি মূলত কিছু নির্দিষ্ট ধারা বা ভাষাগত ব্যাখ্যার ওপর, বিশেষ করে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, বিচার বিভাগের কাঠামো বা ক্ষমতার রূপান্তর সংক্রান্ত দিকগুলোতে। তবে তারা সবাই সংসদের ক্ষমতা ভারসাম্য, সরকারের জবাবদিহিতা এবং নীতি-নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনার প্রশ্নে একমত পোষণ করেছে। এসব দল মনে করে, রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ভেঙে দিয়ে একটি দায়িত্বশীল, বিকেন্দ্রীভূত ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা গঠনের পথে এগোতে হলে সংবিধানিক ও কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। তাদের এই অবস্থান একটি সম্ভাব্য ঐকমত্যের ভিত্তি তৈরি করছে, যা বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার পথে সহায়ক হতে পারে।
এইসব মতানৈক্য সত্ত্বেও, একটি সাধারণ ভিত্তিতে ঐকমত্যের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটিই সংস্কারের জন্য যুগান্তকারী হতে পারে।
নির্বাচন: গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ একসাথে
বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নির্বাচনকে সাংঘর্ষিক না ভেবে বরং সমান্তরালভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এর একটি বাস্তবভিত্তিক রোডম্যাপ হতে পারে:
● একটি সমন্বিত নির্বাচন আয়োজন, যেখানে জনগণ একই সময়ে জাতীয় সংসদ ও গণপরিষদ সদস্য নির্বাচন করবে।
● নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত করে সংবিধান সংশোধন করবেন, একটি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে।
● সংবিধান সংস্কার শেষে গণপরিষদ বিলুপ্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল একটি পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠন করবে।
সমস্যার মূলে রাজনীতি, সমাধানের চাবিকাঠিও রাজনীতি
এই সহজ, কার্যকর ও জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে নির্মিত রোডম্যাপ অনুসরণে অনীহা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা ভাগাভাগির দ্বিধা থেকেই উৎসারিত।
কেউ চায় দ্রুত নির্বাচন, কেউ চায় বিচার আগে, কেউ আবার সংস্কার ছাড়া এগুতে নারাজ—এই অবস্থানগত সংকীর্ণতা আজ সংকটকে দীর্ঘায়িত করছে।
বাংলাদেশ এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন—এই তিনটি স্তম্ভকে সাংঘর্ষিক না ভেবে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নেওয়াই হবে সবচেয়ে যুক্তিসংগত ও কার্যকর পথ। যদি জাতি ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারে, তবে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যেই একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।
আর এটাই হবে স্বৈরাচারের পতনের পর প্রকৃত মুক্তির সূচনা—একটি নতুন রাষ্ট্রীয় চেতনার নবজাগরণ।