একজন রাষ্ট্রনায়ক ইতিহাসকে নির্মাণ করেন। কিন্তু ইতিহাস নির্মাণের পরও যদি তাকে ভুলে যেতে শেখানো হয়, তাহলে জাতির নিজেরই অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হয়। শহীদ জিয়াউর রহমান সেই রাষ্ট্রনায়ক, যার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা মানেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক ও আত্মমর্যাদাভিত্তিক ইতিহাসকে গুলিয়ে ফেলা।
আমরা এখন এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যখন দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বৃহৎ অংশ জানেই না—‘দক্ষিণ তালপট্টি’ কী ছিল, কেন পাহাড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, তারা জানে না, কে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিভাবে খাল খননের মাধ্যমে কৃষিকে বিপ্লবের পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিংবা কীভাবে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক কূটনীতিতে এক সম্মানজনক অবস্থানে উঠে এসেছিল।
এই বিস্মরণ কেবল দুঃখজনক নয়, এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতিলুপ্তির চক্রান্ত—যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আত্মপরিচয়হীন করে রাখার রাষ্ট্রীয় আয়োজনের নামান্তর ছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন এই সব পদক্ষেপের স্থপতি—একজন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি যুদ্ধাহত একটি ভঙ্গুর জাতিকে আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি ছিল কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত একে ‘নিউ মুর’ বলে দাবি করলেও ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সেখানে টহল দিয়ে স্পষ্ট বার্তা দেয়—এটা আমাদের ভূখণ্ড। জিয়াউর রহমানই ছিলেন প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি সীমান্ত ও সামুদ্রিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন মনোভাব দেখিয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তিবাহিনীর প্রভাব ভয়াবহ রূপ নেয়। শহীদ জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন—এই অঞ্চল হাতছাড়া হলে সার্বভৌম বাংলাদেশ বিপন্ন হবে। তিনি সেনাবাহিনী মোতায়েন করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে পাহাড়ে যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, তার ভিত্তি প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াই।
এক সময় বাংলাদেশ ছিল ভারত-সোভিয়েত প্রভাবাধীন রাষ্ট্র। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া এই প্রবণতার বিপরীতে গিয়ে বহুমাত্রিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। তিনি চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, পাকিস্তান, ইরান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভারসাম্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে।
OIC-এ বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে বসানো, SAARC গঠনের উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতির ভিত গড়ে তোলা—প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন অগ্রদূত।
শুধু পররাষ্ট্রনীতি নয়, দেশের ভিতরেও জিয়া শুরু করেন উৎপাদনভিত্তিক বাস্তবায়নমুখী উন্নয়ন রাজনীতি। তিনি জনগণের অংশগ্রহণে ‘খাল খনন আন্দোলন’ শুরু করেন—যা কৃষিকে সেচনির্ভর ও উৎপাদনশীল করে তোলে। ১৯৭৭-৮০ সালের মধ্যে খনন হয় প্রায় ৪ হাজার কি.মি খাল—সেচের আওতায় আসে ৭০ লক্ষ একর জমি। এর ফলে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়।
১৯৭৫ সালে দেশে একদলীয় শাসন (বাকশাল) চালু হয়। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়, সংবাদপত্র বন্ধ হয়, বাকস্বাধীনতা খর্ব হয়। ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমতায় এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠন করেন, ১৯৭৯ সালে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠন করেন।
এটি ছিল ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো এক পদক্ষেপ—যার জন্য তিনি কোনো আন্তর্জাতিক চাপ নয়, দেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনার ওপর আস্থা রেখেই এই পথ বেছে নিয়েছিলেন।
শহীদ জিয়া ছিলেন একজন সেক্যুলার চিন্তাধারায় বেড়ে ওঠা সেনা কর্মকর্তা, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে তিনি ইসলামি মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে একসূত্রে গেঁথে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা দেন—যা জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতির বাইরে রেখে পেশাদার সামরিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি ‘We mean business’ স্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক সংস্কৃতি, সামরিক শৃঙ্খলা এবং উৎপাদনমুখী উন্নয়ন অর্থনীতির সূচনা করেন।
শহীদ জিয়া ছিলেন শিল্পায়ন ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রবক্তা। তিনি বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করেন, উদ্যোক্তাদের উত্সাহিত করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ভিত্তি গড়ে দেন। শিক্ষায় পলিটেকনিক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার করেন, ‘জিয়ার টিউশন’ নামে খ্যাত গরিব মেধাবীদের সহায়তা কর্মসূচি চালু করেন।
শহীদ জিয়াউর রহমান শুধু দেশের নেতৃত্ব দেননি—তিনি একটি দিকহীন জাতিকে জাতীয় আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তার অবদান সরিয়ে দিয়ে কেবল একজন ব্যক্তিকে নয়, একটি রাষ্ট্রদর্শন, নিরাপত্তাবলয় এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতিসত্তাকেই নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে বিগত স্বৈরাচার সরকার।
আজকের তরুণদের জানাতে হবে—কে এই বাংলাদেশ গড়ার ভিত তৈরি করেছিলেন, গণতন্ত্র ও পররাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীন পথচলার যাত্রা কে শুরু করেছিলেন। ইতিহাস ভুলে গেলে শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও হারিয়ে যাবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক