বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন এবং জনগণের দীর্ঘদিনের লালিত প্রত্যাশা—এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি কী ভূমিকা নিচ্ছে, তাদের লক্ষ্য কতটা গণমুখী, আদর্শিক এবং জাতীয় স্বার্থনির্ভর, তা বিশ্লেষণ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিশেষত, বিএনপি যে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করছে, সেই অবস্থান তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি: কৌশল না স্বার্থপরতা?
বিএনপি যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে, তা দেশের অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দল বা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট, সংগঠনের সঙ্গে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নয়। বরং, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণসংহতি আন্দোলন, শ্রমিক-ছাত্র-যুব জোটসহ গণতন্ত্রমঞ্চের অন্যান্য দল, যুগপৎ আন্দোলনের বিভিন্ন দল, জামাতে ইসলামীসহ ইসলাম্পন্থী দল ও সংগঠনের অধিকাংশ গঠনমূলক শক্তিই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জানুয়ারি-জুন সময়সীমার মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। এই বাস্তবতায় বিএনপির একপাক্ষিক নির্বাচন দাবি রাজনৈতিক ঐক্য নষ্ট করার শামিল।
এই অবস্থান এক ধরনের একতরফা মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ, যা ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচনের ছক হতে পারে। ইতিহাস বলে, যে রাজনৈতিক দল জনগণের উপর আস্থা না রেখে কূটচাল ও কৌশলের আশ্রয় নেয়, তার শেষ পরিণতি হয় আত্মবিধ্বংসী।
এই দাবি রাজনৈতিকভাবে একটি সংকীর্ণ কৌশলও হতে পারে, যেখানে দলটি একটি স্বল্প-সময়ের জনপ্রিয়তা বা কূটনৈতিক সুবিধা নিতে চায়। তবে প্রশ্ন হলো—এই দাবি আদৌ টেকসই কিনা এবং এর পেছনে রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাস না রাজনৈতিক ভয় কাজ করছে?
ভারত-নির্ভরতা ও জনমানসের সন্দেহ
বাংলাদেশের জনগণ অনেকটাই জাতীয়তাবাদী আবেগ দ্বারা চালিত। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির কারণে এক সময় এই আবেগ বিএনপির দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু আজ সেই বিএনপি যদি ভারতের কূটনৈতিক চাপ বা সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে, তবে সেটি হবে আত্মঘাতী কৌশল।
যখন জনগণের মধ্যে ধারণা জন্মায় যে, একটি রাজনৈতিক দল বিদেশি রাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না, তখন তাদের প্রতি বিশ্বাস ভেঙে যায়। বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে যেভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, ঠিক তেমনই তারা রাজনৈতিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও আপসহীন।
বিএনপির দ্বৈতনীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ: একদিকে তারা ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলে, অন্যদিকে পরোক্ষভাবে ভারতের সঙ্গে আঁতাতের ইঙ্গিত দেয়। এই দ্বিচারিতা রাজনৈতিকভাবে শুধু বিপজ্জনক নয়, দীর্ঘমেয়াদে আত্মঘাতী।
ঐক্যমত্য থেকে বিভেদ: রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা
জুলাই অভ্যুত্থানে যারা মাঠে ছিল, যারা রক্ত দিয়েছে, যারা সরকারের পতনে মুখ্য ছিল—তাদের অনেকেই এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে গ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ সংলাপ ও কাঠামোগত সংস্কারে মনোনিবেশ করেছে। সেখানে বিএনপি এখনো অতীতকেন্দ্রিক ও স্বার্থনির্ভর রাজনীতির মধ্যে আটকে আছে।
সংস্কারপন্থী দলগুলোর নেতৃত্ব ড. ইউনুসের নেতৃত্বকে আপাতত মেনে নিয়েছে—কারণ তারা জানে, একটি সহনশীল রূপান্তর ছাড়া দেশে গণতন্ত্র স্থায়ী হবে না। কিন্তু বিএনপির একরোখা অবস্থান ঐক্যজোটকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
ড. ইউনুস ও অন্তর্বর্তী সরকার: নেতৃত্বকে উপেক্ষা না গ্রহণ?
ড. মুহাম্মদ ইউনুস একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে নয় বরং একটি সংস্কারমূলক মঞ্চ হিসেবে দেখার কথা ছিল বিএনপির। ইউনুসের সরকার বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
বর্তমান বাস্তবতা হলো—
● আওয়ামী লীগের পতনের পর প্রশাসন অনেকটাই নিরপেক্ষ,
● দলের শীর্ষ নেতারা মুক্ত,
● রাজনৈতিক মামলা প্রায় নিষ্পন্ন,
● দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলনামূলক স্থিতিশীল।
এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনুসের নেতৃত্বে একটি ধাপে ধাপে ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা বাস্তবসম্মত ও ইতিবাচক। অথচ বিএনপি এই সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে—যা সংকট সমাধানের পরিবর্তে সংকট আরও গভীর করছে।
বিএনপির অর্জন ও অস্থিরতা: রাজনৈতিক আত্মঘাত?
দলীয় মামলার নিষ্পত্তি, নেত্রী ও তারেক রহমানের মুক্তি, প্রশাসনে বিএনপির আনুগত্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রত্যাবর্তন—এসব কিছু বিএনপির বড় রাজনৈতিক অর্জন। এরপরেও তারা যদি মাত্র এক বছরের জন্য ধৈর্য না ধরে এবং ক্ষমতায় যাবার জন্য সংঘাত ও কূটচালের আশ্রয় নেয়, তবে তা ক্ষমতার প্রতি তাদের লোভ এবং দুরদর্শিতার অভাবকেই প্রমাণ করে।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দায়িত্বহীনতা
যখন জনগণ রক্ত দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক পরিসর তৈরি করেছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মূল কর্তব্য ছিল সেই গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা এবং জনকল্যাণমুখী সংস্কারে অংশগ্রহণ করা। বিএনপি সে পথে হাঁটেনি।
চাঁদাবাজি, দখলবাজি, প্রশাসনে নিজের প্রভাব বিস্তার—এসব প্রমাণ করে যে দলটি আদতে আওয়ামী শাসনের এক প্রকার প্রতিসরণ। তারা ভিন্ন নামে একই ধাঁচের ক্ষমতার অপব্যবহার চায়। জনগণের ভয়, বিএনপি আবারো সেই পুরনো দমনমূলক, লুটপাটমুখী ব্যবস্থায় ফিরে যাবে।
রাজনৈতিক দ্বিচারিতা: ভারত ও আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ
বিএনপি একদিকে ভারতের দাসত্বের বিরুদ্ধে কথা বলে, অন্যদিকে ভারতের আশীর্বাদে ক্ষমতায় যেতে চায়—এ এক সুস্পষ্ট দ্বিচারিতা। একইভাবে, আওয়ামী লীগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে বিএনপি, কিন্তু নিজেরাও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সেই একই কৌশল ও দমননীতির পথে হাঁটছে।
এই দ্বিচারিতা দলটির নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে তুলেছে। ফলে, অনেকেই মনে করছেন, আওয়ামী লীগ গেছে ঠিকই, কিন্তু ‘আওয়ামীতন্ত্র’ রয়ে গেছে—বিএনপির মাধ্যমে।
জনমানসের প্রতিক্রিয়া ও ম্যান্ডেট
বাংলাদেশের জনগণ পরিবর্তন চেয়েছিল। তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান, ন্যায্যতা ও নীতিগত রাজনীতি চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড—ছাত্রদলের দখল, সন্ত্রাসে মদদ, প্রবাসী বিএনপির ভারতপ্রীতি—সব মিলিয়ে একটি হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে উঠছে।
যে ১৫০০ তরুণ প্রাণ হারিয়েছে, তারা চেয়েছিল ন্যায়ভিত্তিক রাজনীতি। কিন্তু বিএনপির আচরণ তাদের ত্যাগকে অসম্মান করছে।
নির্বাচন বনাম সংস্কার: কোনটি মুখ্য?
শুধু নির্বাচনে জয়লাভ করলেই একটি দল জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। বিশ্বব্যাপী এখন রাজনীতির মানদণ্ড হলো—
● জবাবদিহিতা,
● ন্যায্যতা,
● অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি,
● মানবিক রাষ্ট্রনীতি।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিএনপি এখনো পুরনো ধাঁচের রাজনৈতিক চিন্তায় বন্দি। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা, ত্যাগ, ও নতুন সম্ভাবনার বিপরীতে দলটি প্রায়ই আত্মকেন্দ্রিক আচরণ করছে। সংস্কারকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র নির্বাচনী রাজনীতিতে মনোনিবেশ করা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর।
ভবিষ্যতের পথে: বিপ্লব নাকি পতন?
যদি বিএনপি সহানুভূতিশীল দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন না করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা না করে, জনগণের দাবি বুঝে রাজনীতিকে সংস্কারমুখী না করে, তবে তারা দ্রুতই রাজনীতি থেকে প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। এর ফলাফল হতে পারে—
● একটি দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প বিপ্লবী সরকার,
● নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান,
● বিএনপির রাজনৈতিক পতন।
ড. ইউনুস শুধু একটি নির্বাচন করাতে আসেননি; তিনি একটি টেকসই, গ্রহণযোগ্য এবং জনমুখী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছেন। এই যাত্রায় বিএনপির ভূমিকা হতে পারে সহায়কের, আবার ব্যর্থতার দায়ভার বহনকারীরও।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে যে অধ্যায় চলছে, তা ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতির ভিত্তি গড়ে দেবে। বিএনপির সামনে দুটি পথ—একটি হলো আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আদর্শিক ও কৌশলগত পুনর্গঠন, অন্যটি হলো ক্ষমতালোভে অন্ধ হয়ে জাতীয় ঐক্য ভাঙা।
তাদের জন্য এখন সময় নিজেদের নতুনভাবে গড়ে তোলার।
একটি বছর ধৈর্য ধরে, অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করে, দলের কাঠামো সংস্কার করে, সমাজমুখী এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতিতে ফিরে আসা—এই পথেই বিএনপির পুনর্জন্ম সম্ভব। অন্যথায়, একটি ঐতিহাসিক সুযোগ তারা চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
বিজ্ঞান, ইতিহাস, অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি—সবই বলছে, দ্বিতীয় পথটি ধ্বংসের। এখন সিদ্ধান্ত বিএনপির।
— মুনতাসির রাসেল
লেখক ,সংগঠক।
আর