“শহীদেরা রক্ত দিয়েছিলেন শুধু ভোটের তারিখ নির্ধারণের জন্য নয়, একটি নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর পুনর্গঠনের জন্য।”
১৩ জুন ২০২৫, লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেল অনুষ্ঠিত হলো—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বহুল প্রতীক্ষিত সংলাপ। এতে মুখোমুখি বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে এটি কেবল দুই নেতার আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল না—বরং এক বিপ্লবী রাষ্ট্রচিন্তার মুখোমুখি দাঁড়ায় ক্ষমতার পুরনো পুনরুৎপাদনের ছক।
স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মাত্র এক বছরেরও কম সময় আগে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থাননের পর জাতির প্রত্যাশা ছিল এই অন্তর্বর্তী সরকার কেবল একটি নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের একটি রূপরেখা দেবে। কিন্তু যা এল, তা ছিল হতাশাজনক—কেবল একটি সম্ভাব্য নির্বাচনকাল। সংবিধান সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন, স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ—এসব মৌলিক প্রশ্ন উপেক্ষিত থেকে গেল যৌথ বিবৃতিতে। শহীদদের স্বপ্ন যেন ঢাকা পড়ল এক নিঃশব্দ চুক্তিভঙ্গের আবরণে।
১৩ জুনের সংলাপ তাই এক তারিখ নয়, বরং এক নতুন প্রশ্নবোধকচিহ্ন—রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি আদৌ প্রস্তুত সেই রক্তস্নাত আদর্শিক উত্তরাধিকার বহন করতে, নাকি তারাও রাষ্ট্রকে কেবল ক্ষমতার পাত্র হিসেবেই দেখছে? এই দিনটি হয়ে রইল রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাস্তবতার মধ্যকার সংঘর্ষের এক প্রতীকী সূচনাবিন্দু।
সংলাপের আড়ালে যে অভাব প্রকট
এই সংলাপকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, একদিকে ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে একটি মৌখিক ঐকমত্যে পৌঁছানোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের রূপরেখা সংক্রান্ত মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের প্রশ্ন একেবারে উপেক্ষিত থেকেছে। অথচ মাত্র পাঁচ মাস আগে, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে দেয়া সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে চারটি কাঠামোগত প্রস্তাব, যা কেবল রাজনৈতিক সংস্কারের আহ্বান নয়—বরং একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার রূপরেখা।
প্রথমত, সংবিধানের মূলনীতিতে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”, “মানব মর্যাদা”, “সামাজিক ন্যায়বিচার” ও “বহুত্ববাদ” যুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে—যার লক্ষ্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক ও নাগরিকভিত্তিক রাষ্ট্রপরিচয় গড়ে তোলা।
দ্বিতীয়ত, এক কক্ষীয় সংসদের পরিবর্তে একটি দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা—৪০০ সদস্যের জাতীয় সংসদ ও ১০৫ সদস্যের সিনেট—গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা অঞ্চলভিত্তিক ভারসাম্য, নীতিনির্ধারণে পরিপক্বতা ও সংবিধান পর্যালোচনায় স্থায়িত্ব আনবে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাব রয়েছে, যাতে এককেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদ প্রতিরোধ করে চুক্তিভিত্তিক, অংশীদারিত্বমূলক রাজনীতির পথ তৈরি হয়।
চতুর্থত, “জাতীয় সংবিধানিক কাউন্সিল” (NCC) গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই চারটি প্রস্তাব কেবল একটি আইনি সংস্কার নয়—বরং একটি কাঠামোগত রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর। যখন জরুরি ছিল “নির্বাচনের তারিখ কবে হবে”—এই প্রশ্নের বাইরে গিয়ে “রাষ্ট্র কেমন হবে, কার পক্ষে হবে, কী ন্যায়ের ভিত্তিতে চলবে”—এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা তখন ১৩ জুনের সংলাপে এই বিশাল অগ্রগতি উপেক্ষিত হওয়াই প্রমাণ করে, বর্তমান আলোচনার পরিধি এখনো অতীতের রাজনীতির ছায়া ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কল্পনার স্তরে পৌঁছায়নি। তাই প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্র কী আবারও “নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র” নামক ছদ্মবেশী ফাঁদে পা দিচ্ছে?
শহীদদের রক্ত কিসের জন্য?
২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত এক মাসব্যাপী গণঅভ্যুত্থানে অন্তত দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হন—এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক জাগরণ। এই অভ্যুত্থান কেবল “ভোটাধিকার” পুনরুদ্ধারের আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল এক নতুন রাষ্ট্রকাঠামো ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবিতে সংঘটিত গণজোয়ার।
তখন তারা মূলত যা চেয়েছিল সেগুলো ছিল—ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিলোপ; নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র কাঠামোর রূপান্তর; ভারত-পাকিস্তান বা অন্যকোন দেশপন্থী রাজনীতির অবসান; শহীদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রাখতে কাঠামোগত পরিবর্তন; দলনিরপেক্ষ, জনগণনির্ভর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন; ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, কাঠামোকেন্দ্রিক রাজনৈতিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা।
এই শহীদদের রক্ত দিয়ে আজকে যদি কেবল “নির্বাচনের মাস” নিয়ে আলোচনাই হয়, তাহলে সেই রক্তের সঙ্গে প্রতারণা হয়। এর চেয়েও বড় কথা, ইতিহাসের ব্যর্থতা আরেকবার পুনরাবৃত্ত হয়।
সংবিধান সংস্কার: রাষ্ট্র পুনর্গঠনের উপেক্ষিত রূপরেখা
১৩ জুনের ইউনূস-তারেক সংলাপে আলোচিত হলো কেবল একটি সম্ভাব্য নির্বাচনকাল, অথচ আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল একটি নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর সন্ধান। এই পটভূমিতে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনাগুলো ছিল আন্দোলনের অন্তর্নিহিত চেতনার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। কিন্তু আজ, যখন জাতি একটি ভবিষ্যতমুখী সমঝোতার অপেক্ষায়, তখন এই রূপরেখা কোনো আলোচনায়ই নেই।
বিএনপি যেখানে কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলো সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে, সরকারও তাতে নিশ্চুপ—ফলে এই যুগান্তকারী সংস্কারের আলোচনা কার্যত নির্বাসনে। ফলে শহীদের আত্মত্যাগ—যেটি কেবল ভোটাধিকারের জন্য ছিল না, বরং এক নতুন রাষ্ট্রচিন্তার জন্য—তা পুনরায় অতীতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কবলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এই উপেক্ষা আসলে আন্দোলনের চেতনারই এক বিপর্যয়।
রাজনীতির ফাঁদ: পুনরাবৃত্ত ব্যর্থতা?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো—আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত সম্ভাবনার কাঠামোগত রূপায়ণ কখনোই ঘটেনি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান তার সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। তৎকালীন তিন জোটের সম্মিলিত প্রয়াসে স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ খুলে যায়, কিন্তু সংবিধান বা রাষ্ট্র কাঠামোয় কোনো মৌলিক সংস্কার ঘটেনি।
ফলে পুরোনো দলীয় স্বার্থে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোই পুনর্ব্যবহৃত হতে থাকে—যার ফলাফল আমরা দেখি ১/১১-এর সেনা-সমর্থিত ‘সংস্কার’, এবং পরে ‘ডিজিটাল স্বৈরতন্ত্র’ নামে খ্যাত এক দলীয় আধিপত্যের পুণঃপ্রতিষ্ঠা। আজকের অন্তর্বর্তীকালীন সংকট সেই অসম্পূর্ণ রূপান্তরেরই ধারাবাহিকতা।
এই বাস্তবতায় একটি প্রশ্ন সামনে আসে, বর্তমান রাজনৈতিক শক্তিগুলো কি সেই পুরোনো ব্যর্থ ছকেই আবারও হাঁটছে? যদি তাই হয়, তবে গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য—একটি জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল, ন্যায্য এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা—আবারও অধরাই থেকে যাবে। অথচ সমাজের মনস্তত্ত্ব বলছে ভিন্ন কিছু। মার্চ ২০২৫-এ পরিচালিত একটি জনমত জরিপে দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ মানুষ সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্বিন্যাসের পক্ষে মত দিয়েছেন।
অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেখানে পুরোনো ফ্রেমে আটকে আছে, সেখানে জনগণের আকাঙ্ক্ষা একটি নতুন রাষ্ট্রের দিকেই ইঙ্গিত করছে। এই ব্যর্থতা যদি বারবার পুনরাবৃত্ত হয়, তাহলে তা শুধু রাজনৈতিক ব্যবস্থার নয়—আন্দোলনের নৈতিকতারও এক গভীর বিপর্যয় হয়ে উঠবে।
নির্বাচনের বাইরেও আর যা ভাবতে হবে
৫ আগস্টের আগেই যে দাবিগুলো ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ঘোষিত হয়েছিল—তাদের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ বিলুপ্তির রূপরেখা ও নতুন এক প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি নির্মাণ। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের সময়সূচি বা সরকার গঠনের খুঁটিনাটি বিবরণ যথেষ্ট নয়। সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে রাষ্ট্রপুনর্গঠন প্রশ্নকে। কারণ কেবল তারেক-ইউনূস বৈঠক নয়, শহীদেরা রক্ত দিয়েছিলেন একটি নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর জন্মদানের জন্য। তাই নির্বাচনের বাইরেও যে দাবিগুলো এখন প্রাসাঙ্গিক—
● “জুলাই ঘোষণা-পত্র” অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে — রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রূপরেখা ও আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে একটি প্রস্তাবিত জুলাই প্রোক্লেমেশন প্রস্তুত ও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে হবে।
● রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারকে সংলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে—শুধু নির্বাচন কবে হবে তা নয়, রাষ্ট্র ভবিষ্যতে কিভাবে পরিচালিত হবে—এ প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে।
● রাষ্ট্র সংস্কার কমিশনের সুপারিশ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে—সংলাপের বাইরে এসে গণশুনানি, সাংবিধানিক সম্মেলন এবং বিশেষজ্ঞ-জনতার সম্মিলনে আলোচনার আয়োজন করতে হবে।
● জাতীয় সংবিধান কাউন্সিল (NCC) গঠন নিশ্চিত করতে হবে—এটি ব্যতীত কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানই নিরপেক্ষভাবে গঠিত হতে পারে না।
● স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে—বর্তমান কেন্দ্রভিত্তিক রাজনীতি জনগণের নিয়ন্ত্রণহীনতার বড় কারণ। জনগণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে নিচের স্তর থেকে।
● শহীদদের স্বপ্নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে—তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে কাঠামোগত পরিবর্তনের পথ উন্মুক্ত হয়েছে, তা যেন নির্বাচনী হুলস্থুলের মধ্যে হারিয়ে না যায়।
১৩ জুনের সংলাপ ছিল একটি অপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা—যেখানে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি আলোচিত হলেও রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার নিয়ে আলোচনা ছিল না। এই ধরনের আংশিক সংলাপ রাজনীতিকে হয়তো সাময়িক স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু তা রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান নয়। বরং এটি আরেক ১/১১ ডেকে আনার পূর্বাভাস।
রাজনীতিবিদরা যদি শহীদের স্বপ্ন ভুলে যান, তাহলে জনগণ সেই শূন্যতা পূরণ করতে আবারও প্রস্তুত হবে। সময় এসেছে—সংলাপকে সময়সূচির গণ্ডি থেকে বের করে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রকৃত আলোচনায় রূপান্তর করার। শহীদের রক্ত, নিপীড়িতের কান্না এবং সংস্কারের অঙ্গীকার—এই তিনে গঠিত হোক আগামীর বাংলাদেশ।
— মুনতাসির রাসেল
লেখক ,সংগঠক।