- বিয়ের আগে বাবার বাড়ি, বিয়ের পরে নিজের স্বামীর বাড়ি, নারী তোমার নিজের বাড়ি কই?
একটি প্রশ্ন নয়, বরং নারীর অস্তিত্ব, পরিচিতি এবং সমাজে তার স্থান নিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস। নারী তোমার নিজের বাড়ি কই?।
শৈশব ও বাবার বাড়ির আশ্রয়ে
বিয়ের আগে নারীর ঠিকানা তার বাবার বাড়ি। এই বাড়িতেই তার বেড়ে ওঠা, ছোট থেকে বড় হওয়া, শিক্ষা লাভ এবং স্বপ্ন দেখা। এটি তার প্রথম নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে সে নিজের মতো করে হাসে, খেলে, কাঁদে এবং আত্মপ্রকাশ করে। বাবার বাড়ি তার শিকড়, তার পরিবার, তার প্রথম পরিচিতি। এখানে সে কন্যা, বোন, নাতনি—অগণিত সম্পর্কের জালে বাঁধা। এই বাড়ি তাকে নিরাপত্তা দেয়, স্নেহ দেয় এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। প্রতিটি কোণায় তার স্মৃতি জড়িয়ে থাকে, প্রতিটা ইট যেন তার কৈশোরের গল্পের সাক্ষী। কিন্তু এই আশ্রয় চিরস্থায়ী নয়, কারণ সমাজের প্রচলিত ধারণায় নারীকে একদিন ‘পরের ঘরে’ যেতেই হয়।
বিয়ের পর নতুন ঠিকানা: স্বামীর বাড়ি
বিয়ে এক নতুন জীবনের সূচনা। বাবার বাড়ি ছেড়ে নারী পা রাখে এক নতুন ঠিকানায়—তার স্বামীর বাড়ি। এখানে তাকে গড়ে তুলতে হয় নতুন সম্পর্ক, মানিয়ে নিতে হয় নতুন পরিবেশ, নতুন রীতিনীতি। সে হয়ে ওঠে স্ত্রী, পুত্রবধূ, ভাবী, মাসি—নতুন সব পরিচয়ে পরিচিত হয়। স্বামীর বাড়ি তার ‘নিজের বাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, কিন্তু এই পরিচিতি কতটা নিজস্ব, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাকে তার নিজের অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দ, এমনকি নিজের স্বপ্নগুলোকেও অনেক সময় নতুন বাড়ির ছাঁচে ফেলতে হয়। এখানে তার প্রধান ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের যত্ন নেওয়া, সন্তান লালন-পালন করা এবং সবার সাথে নিজেকে মানিয়ে চলা। এই বাড়িতেই সে নিজের একটি জগৎ তৈরি করে, যেখানে তার ভালোবাসা, ত্যাগ এবং পরিশ্রম মিশে থাকে। তবুও, এই ‘নিজের বাড়ি’ কি সত্যিই তার নিজস্ব সত্তার প্রতিফলন?
নিজস্বতার খোঁজ: নিজের বাড়ি কই?
এই প্রশ্নটিই আসলে নারীর নিজস্ব অস্তিত্বের সঙ্কটকে তুলে ধরে। বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি—এই দুই ঠিকানার মধ্যে নারী তার নিজস্ব ঠিকানাটি খুঁজে ফেরে। এই ‘নিজের বাড়ি’ কি শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান, নাকি এটি তার আত্মপরিচয়, তার
স্বাধীনতা এবং তার নিজস্ব জগতের প্রতীক?
আধুনিক সময়ে এই ধারণায় পরিবর্তন আসছে। অনেক নারীই এখন পড়াশোনা শেষ করে, কর্মজীবনে প্রবেশ করে এবং আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হয়। তারা নিজের উপার্জনে ফ্ল্যাট কেনে বা বাড়ি তৈরি করে। এই বাড়িটি শুধু একটি বাসস্থান নয়, এটি তার পরিশ্রম, তার সংগ্রাম এবং তার নিজস্ব স্বপ্নপূরণের প্রতীক। এই বাড়িটি তার নিজের আয়ত্তে, নিজের সিদ্ধান্তেই তৈরি হয়। এখানে সে তার নিজের মতো করে জীবনযাপন করতে পারে, কোনো সামাজিক বা পারিবারিক চাপ ছাড়াই। এই ক্ষেত্রে, তার ‘নিজের বাড়ি’ হয়ে ওঠে তার স্বতন্ত্রতা এবং আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক।
তবে, যারা আর্থিক দিক থেকে এখনো স্বাবলম্বী নন, তাদের জন্য এই প্রশ্নটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তাদের কাছে ‘নিজের বাড়ি’ মানে কেবল একটি বাসস্থান নয়, বরং এমন একটি জায়গা যেখানে তারা নিজেদের সত্তাকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে, যেখানে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং যেখানে তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি হতে পারে স্বামীর বাড়ির একটি নির্দিষ্ট কোণ, যেখানে সে তার নিজের মতো করে সাজাতে পারে, বা তার নিজস্ব একটি শখের জগৎ। এই ‘নিজের বাড়ি’ তাই কেবল ইটের গাঁথুনি নয়, বরং এটি আত্মসম্মান, স্বাধীনতা এবং ভালোবাসার এক আশ্রয়।
উপসংহার
নারী জীবনচক্রের এই দুটি প্রধান ঠিকানার মাঝে তার ‘নিজের বাড়ি’ খোঁজার এই যাত্রা আসলে তার আত্মানুসন্ধানের যাত্রা। এটি কেবল একটি প্রশ্ন নয়, এটি সমাজের প্রতি একটি আহ্বান—যেন নারীকে কেবল একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে আবদ্ধ না করে তার নিজস্ব সত্তাকে সম্মান জানানো হয়। নারী যখন তার ‘নিজের বাড়ি’ খুঁজে পায়, তখন সে কেবল একটি নিরাপদ আশ্রয় পায় না, বরং তার আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা এবং ভালোবাসার জগৎ প্রসারিত হয়। তার নিজস্ব একটি ঠিকানা থাকা মানে তার নিজস্ব একটি গল্প থাকা, যা সে নিজের মতো করে লিখতে পারে। একজন নারীর জন্য নিজের আর্থিক স্বাধীনতা তার ‘নিজের বাড়ি’ খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?
এএস/