বাঙলি জাতিসত্তা হাজার বছরের পুরোনো। এই জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সাহসিকতা, সংগ্রাম ও সংস্কৃতি আজও বিশ্ব ইতিহাসে আলোচনার বিষয়। কিন্তু একটিই দুর্বলতা বারবার জাতির অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো মেধার অবমূল্যায়ন।
এই সংকট আজ এতটাই প্রকট যে, রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, সমাজব্যবস্থা, এমনকি পারিবারিক মূল্যবোধেও তার চিহ্ন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
ক. প্রতিভার পেছনে রাজনীতি:
বাংলাদেশে একজন মেধাবী ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বের হলে প্রথমেই দেখে, যোগ্যতার চেয়ে প্রভাব, রাজনৈতিক পরিচয় এবং অর্থবিত্তের মূল্য বেশি। সরকারি চাকরিতে মেধার চেয়ে ‘চাহিদাসম্পন্ন’ রেফারেন্স, দলীয় আনুগত্য বা ঘুষ বড় ভূমিকা রাখে।
২০১৯ সালের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা যায়, সরকারি নিয়োগে দুর্নীতি ও দলীয়করণের হার প্রায় ৬৮%। অর্থাৎ, প্রকৃত মেধাবীরা শুরুতেই পিছিয়ে পড়েন। ফলে একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ—মানবসম্পদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
খ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধার অপমান:
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুলগুলোতেও দেখা যায়—মেধাবীরা চুপচাপ থাকে, সৃজনশীল হয়, প্রশ্ন করে; আর প্রশ্ন করলেই তারা ‘ঝামেলাবাজ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। শিক্ষক, প্রশাসক ও রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলো প্রথাবিরুদ্ধ মেধাবীকে দমন করে। ফলে প্রতিভা ঝরে পড়ে; কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে যায়, কেউবা হতাশায় তলিয়ে যায়।
একটি জাতি যখন তাদের সেরা সন্তানদের মুখ থুবড়ে ফেলে রাখে, তখন সে জাতির উন্নয়ন কেবল স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকে। এটি এখন আমাদের সমাজে ভয়াবহ বাস্তবতা।
গ. শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে উপেক্ষিত মেধা:
বাঙালি জাতির পরিচয় শুধু রাজনীতিতে নয়, সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, চিত্রকলায়। কিন্তু এখানে যাদের চিন্তা ভিন্ন, যাদের কণ্ঠ প্রশ্নবিদ্ধ, তারা সহজেই সুযোগ পান না। প্রতিভার স্বীকৃতি পায় ‘চেনাজানা’দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে।
উদীয়মান কবি-লেখক-চিত্রশিল্পীদের বই প্রকাশ পায় না, চিত্র প্রদর্শনী হয় না, নাটক মঞ্চায়ন হয় না—শুধু তারা ‘সুবিধাভোগী চক্রের’ সদস্য নন বলে। এতে করে জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ সংকুচিত হয়। সাংস্কৃতিক বিকাশ থেমে যায়।
ঘ. গবেষণা ও উদ্ভাবনে হতাশা:
একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে গবেষণা ও উদ্ভাবনের উপর। অথচ বাংলাদেশে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাজেট সামান্য এবং সেটাও সঠিকভাবে কাজে লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে মেধাবীদের চেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষকদের নাম থাকে বেশি। ফলে প্রকৃত গবেষণা হয় না।
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর মত বিশ্বমানের মেধাবীরা ছিলেন ব্যতিক্রম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ দেশের মেধাবীরা মূল্যায়িত না হয়ে বিদেশমুখী হয়ে পড়ে। মেধার এই ব্রেইন ড্রেইন (brain drain) জাতির জন্য চরম ক্ষতির কারণ।
ঙ. মিডিয়ার ভূমিকা:
আমাদের গণমাধ্যমেও মেধার মূল্যায়নের জায়গা সংকুচিত। সত্যিকারের চিন্তাশীল লেখক বা বুদ্ধিজীবীকে মিডিয়া তেমন জায়গা দেয় না যতটা দেয় বিতর্কিত, ট্রেন্ডি বা রাজনীতিক ঘনিষ্ঠদের।
ফলে সমাজে একধরনের ‘নকল মেধাবীর’ উদ্ভব ঘটে—যাদের কণ্ঠস্বর প্রচারিত হয়, কিন্তু তা জাতির প্রকৃত প্রয়োজন মেটায় না। জাতিসত্তার বিকাশ হয় বিকৃতভাবে, ভিত্তিহীন কথার জালে।
চ. সামাজিক বৈষম্য ও অভিভাবক সমাজ:
বাড়ির অভিভাবকরাও অনেক সময় তাদের সন্তানদের মেধার মূল্যায়ন না করে পরীক্ষার নম্বর বা প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। শিশুর মৌলিক চিন্তা, সৃজনশীলতা, প্রশ্ন করার ক্ষমতা ধ্বংস করে তাকে এক রোবট বানিয়ে তোলা হয়। এটি একটি সাংস্কৃতিক রোগে পরিণত হয়েছে।
ছ. কীভাবে মুক্তি মিলবে?
নীতিগত পরিবর্তন : সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা এবং মেধার মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো: গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকৃত গবেষকেরা যেন নেতৃত্ব পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
সংস্কৃতির মঞ্চ উন্মুক্ত করা: তরুণ প্রতিভাদের সুযোগ দিতে হবে। একঘেয়ে ও বাণিজ্যিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সাহসী সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে।
মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা: মিডিয়াকে মেধাবী চিন্তাবিদদের জায়গা করে দিতে হবে। তারা যেন সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিবার ও শিক্ষা ব্যবস্থা: ছোটবেলা থেকেই শিশুর মেধা ও মননের বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে, তাকে প্রশ্ন করার, নতুন ভাবার ও ভিন্ন কিছু করার সাহস দিতে হবে।
মেধার অবমূল্যায়ন কেবল একটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতি নয়—এটি গোটা জাতির বিকাশে বাধা। এক একটি মেধা মানে একটি সম্ভাব্য পদার্থবিজ্ঞানী, একজন কবি, একজন গবেষক, একজন রাষ্ট্রনায়ক। যখন রাষ্ট্র কিংবা সমাজ তাদের অগ্রাহ্য করে, তখন সেই জাতির ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
বাঙালি জাতিসত্তার শক্তিমত্তা নিহিত আছে তার চিন্তা, সৃজনশীলতা, মেধা ও সাহসিকতায়। কিন্তু যদি সেই মেধাকেই অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে আমরা কেবল ইতিহাসের পাতায় গৌরব খুঁজি, বাস্তবতায় পথ হারিয়ে ফেলি।
জমির উদ্দিন মিলন