প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে জনগণের মতামতই যদি সর্বশেষ কথা হয়, তাহলে সেই মতামতের প্রতিফলনের পদ্ধতিই নির্ধারণ করে গণতন্ত্র কতটা কার্যকর। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা PR (Proportional Representation) পদ্ধতি তাত্ত্বিকভাবে যতই ন্যায্যতার কথা বলুক না কেন, বাস্তবে এটি একটি দলনির্ভর ও ক্ষমতা-কেন্দ্রিক নির্বাচনব্যবস্থা, যেখানে ভোটার ব্যক্তি নয়, দলকে ভোট দেন—ফলে জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠেন দলের অনুগত নিযুক্তি, জনগণের প্রতিনিধি নয়।
এতে জনসাধারণের সঙ্গে সরাসরি জবাবদিহিতার সম্পর্ক ভেঙে পড়ে, নেতৃত্ব আসে দলীয় আনুগত্য থেকে, আর স্বাধীন বা স্বতন্ত্র কণ্ঠগুলো হয়ে পড়ে কোণঠাসা। গণতন্ত্রে জনগণের শক্তি ফিরিয়ে আনতে চাই দলনির্ভর নয়, মানুষনির্ভর নির্বাচন।
গণতন্ত্র কি কেবল দলনির্ভর?
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতির মূল সংকটটি লুকিয়ে আছে এর প্রতিনিধিত্বের ধরনে—এখানে ভোটার কোনো ব্যক্তিকে নয়, ভোট দেন একটি রাজনৈতিক দলকে। এতে নির্বাচিত এমপি কে হবেন, তা ঠিক করেন দলীয় হাইকমান্ড; ভোটার জানেন না সেই ব্যক্তিকে, তার কর্ম বা আদর্শকেও না। ফলে একজন এমপি হয়ে ওঠেন দলের করুণা-নির্ভর নিযুক্তি, জনগণের প্রতিনিধি নয়। ভোটার ও প্রতিনিধির মাঝে যে সরাসরি সংযোগ গণতন্ত্রের প্রাণ, PR পদ্ধতিতে তা ভেঙে পড়ে। জবাবদিহিতা হয় দলমুখী, জনমুখী নয়। গণতন্ত্র মানে কেবল আসন ভাগাভাগি নয়—এটি মানে জনগণের সঙ্গে জীবন্ত, দৃশ্যমান এক সম্পর্ক, যা দলীয় তালিকার অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
দলতন্ত্র বনাম জনগণতন্ত্র
PR (Proportional Representation) পদ্ধতিতে সংসদ অনেকটা রাজনৈতিক দলের ‘অফিস রুম’-এ পরিণত হয়, যেখানে সিদ্ধান্ত নেয় কুশলী কৌশলবিদেরা, আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা হয়ে পড়েন নীরব দর্শক। ভোটে জয়ী হয়ে আসা নয়, বরং দলনেতার আনুগত্যই হয়ে ওঠে পদ পাওয়ার মাপকাঠি। এতে করে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা ক্ষয়ে যায়—প্রার্থী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতি, নেতৃত্বে বংশপরম্পরা, আর একক কর্তৃত্বের সংস্কৃতি আরও গভীর হয়। এমন পদ্ধতিতে যদি জনগণের রায় নয়, বরং দলের মনোভাবই ঠিক করে কে হবেন প্রতিনিধি—তবে প্রশ্ন জাগে, ভোটার কেন ভোট দেবেন? গণতন্ত্র কি তবে কেবল ভোট দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা, নাকি প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার?
স্বতন্ত্র প্রার্থী: হারানো গণতন্ত্রের সম্ভাবনা
PR পদ্ধতির সবচেয়ে গভীর সংকট হল—এটি স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য গণতন্ত্রের দরজাই বন্ধ করে দেয়। কোনো শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষিবিদ বা সাংস্কৃতিক কর্মী—যিনি রাজনীতির বাইরে থেকেও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখেন—তিনি যদি জনগণের আস্থা নিয়ে প্রার্থী হতে চান, PR পদ্ধতিতে তা কার্যত অসম্ভব। কারণ এখানে নির্বাচনের টিকিট দেয় রাজনৈতিক দল, ভোট পড়ে দলের প্রতীকে, ব্যক্তির নামে নয়। অথচ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তো এখানেই—সাধারণ মানুষও নেতৃত্বে আসতে পারেন, কেবল দলের ছায়ায় নয়, নিজের যোগ্যতায়। PR সেই সম্ভাবনাকে আটকে দেয়, এবং রাজনীতিকে কেবল দলনির্ভর পেশায় রূপান্তরিত করে। দলহীন একজন ভালো মানুষ যেন নেতৃত্বে আসতে না পারেন—এটাই কি তাহলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ?
ভোটের অপচয় নাকি জনমতের বিকৃতি?
PR পদ্ধতির সমর্থকেরা বলেন—এটি ন্যায্য, কারণ এতে ‘ভোটের অপচয়’ হয় না। কিন্তু এই ন্যায্যতা কেবল সংখ্যার খেলায় সীমাবদ্ধ। একজন ভোটার হয়তো বিশ্বাস নিয়ে একটি দলকে ভোট দিলেন, কিন্তু সেই দলের তালিকায় যদি স্থান পায় দুর্নীতিবাজ, স্বজনপোষী বা সম্পূর্ণ অযোগ্য কেউ, তাহলে সেই ভোটারের ইচ্ছা ও মূল্যবোধ কি আদৌ প্রতিফলিত হলো? গণতন্ত্র শুধু সংখ্যার হিসাব নয়—এটি নীতির, আস্থার এবং জবাবদিহিতার প্রতীক। PR পদ্ধতিতে ভোট সঠিক জায়গায় পৌঁছালেও, প্রতিনিধিত্ব যদি পৌঁছে না দেয় সৎ ও যোগ্য মানুষকে, তাহলে তা আসলে গণতন্ত্রের নামে বিভ্রম। জনগণ সংখ্যায় হারেন না, হারান যখন তাদের বিশ্বাসের অপব্যবহার হয়।
বাংলাদেশ: নারীদের প্রতিনিধি নাকি দলের প্রতিনিধি?
বাংলাদেশে বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনে PR পদ্ধতি ব্যবহার হলেও, বাস্তবে এসব এমপি নির্বাচিত নন—নিযুক্ত। দলনির্ধারিত তালিকা থেকে মনোনয়ন পাওয়ায় তারা হন দলনেতার প্রতিনিধি, জনগণের নয়। ফলে নারী প্রতিনিধিত্বের যে উদ্দেশ্য ছিল—নারীর কণ্ঠস্বরকে সংসদে পৌঁছানো—তা থেকে সরে গিয়ে এটি রূপ নেয় রাজনৈতিক অনুগত্যের পুরস্কারে। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন কেবল সংখ্যা দিয়ে মাপা যায় না; সেটি নিশ্চিত হয় যখন একজন নারী সরাসরি জনগণের রায় নিয়ে নেতৃত্বে আসেন, নিজের অধিকার, কর্ম ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে—not by selection, but by election. দলনির্ভর নয়, জনগণনির্ভর নারী নেতৃত্বই হতে পারে সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়নের ভিত্তি।
গণতন্ত্রকে জাগিয়ে তুলতে চাই স্বতন্ত্র শক্তি
একটি সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে এমন প্রতিনিধি, যিনি দলের নির্দেশ নয়, জনগণের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেবেন। তিনি হবেন স্বতন্ত্র, নিজস্ব চিন্তা ও মূল্যবোধে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নাগরিক—যার অবস্থান জনগণের পাশে, রাজনৈতিক কার্যালয়ের ভেতরে নয়। কিন্তু বর্তমান PR পদ্ধতি এমন স্বতন্ত্র কণ্ঠকে সংসদে ঢোকার পথই প্রায় বন্ধ করে দেয়। এখানে জনপ্রতিনিধিত্ব মানেই দলীয় মনোনয়ন, দলীয় আনুগত্য, আর দলনির্ধারিত তালিকা। ফলে সংসদে জায়গা হয় দলের মুখপাত্রদের, জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়। গণতন্ত্রে প্রয়োজন স্বাধীন চিন্তার প্রতিনিধি, যিনি সাহসের সঙ্গে বলবেন—দল নয়, জনগণই আমার দায়বদ্ধতা। PR পদ্ধতিতে সেই কণ্ঠ আজ রুদ্ধ।
নেতৃত্ব আসুক জনগণের রায় থেকে, দলের মনোনয়ন থেকে নয়
এটা সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক দাবি—নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন জনগণ, কোনো রাজনৈতিক দল নয়। একজন প্রতিনিধি আসবেন জনগণের সরাসরি রায় থেকে, যার ভিত্তি হবে তার ব্যক্তিগত সততা, জনসেবার অভিজ্ঞতা, এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা; শুধু দলীয় প্রতিশ্রুতি বা হাইকমান্ডের আনুগত্য নয়। দলনির্ভর মনোনয়নে নেতৃত্বে আসা মানুষ নয়, নেতৃত্বে আসুক কর্ম, চরিত্র ও আস্থার ভিত্তিতে নির্বাচিত ব্যক্তি। গণতন্ত্র তখনই সত্যিকার অর্থে কার্যকর হয়, যখন জনগণ নিজের প্রতিনিধি নিজেই বেছে নিতে পারে—দলীয় তালিকা নয়, ব্যালটের শক্তির মাধ্যমে।
নিশ্চয়ই! নিচে আপনার বক্তব্যকে প্রথম আলো পত্রিকার স্টাইল এবং ভাষায় সাজিয়ে ফেসবুক পোস্ট হিসেবে উপযোগী করে দিলাম:
বাংলাদেশের জন্য PR বা প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতির বিপদসমূহ
বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘প্রতিনিধিত্বের সঠিক বিচার’ নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে যদি হঠাৎ করেই প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটা দেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথমত, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতা এ ধরনের পদ্ধতির জন্য এখনও প্রস্তুত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতৃত্বের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থান্বেষণ প্রবল। PR পদ্ধতিতে ভোটের ভাগাভাগির মাধ্যমে আসন বরাদ্দ হলে, দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও ক্ষমতা লুটতান্ত্র আরও বেড়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, PR পদ্ধতি নির্বাচনী এলাকার সরাসরি যোগাযোগকে দুর্বল করে দেয়। এখন যেভাবে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি তার এলাকার মানুষদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রেখে তাদের সমস্যা বুঝে কাজ করে, তা অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হবে। ভোটারদের পক্ষে নিজের প্রতিনিধি চেনা ও তাদের কার্যক্রম মূল্যায়ন করাও কঠিন হয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে অনেক ছোট ও গুটিকয়েক দলই রাজনীতির মূলধারায় শক্ত অবস্থান নেয় না। PR পদ্ধতিতে ছোট ছোট দলগুলোর প্রাধান্য বেড়ে গেলে, জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অল্প অঙ্কের ভোটে ছোট দলগুলো বড় ভূমিকা নিলে রাজনৈতিক বিভাজন গড়ে উঠবে, যা জাতীয় উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়।
অতএব, বাংলাদেশের জন্য এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা আদৌ যুক্তিযুক্ত হবে কি না, সেটি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা দরকার। গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য ‘জনগণের ভোটের সরাসরি সাড়া’ নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত, যাতে প্রতিনিধিরা জনগণের কাছ থেকে সরাসরি দায়বদ্ধ থাকে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা উন্নত করতেই হবে, কিন্তু সেটি যেন আরও বেশি স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ ঘটায় — না যে বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দেয়।
গণতন্ত্র কেবল সংখ্যার খেলা নয়—এটি মূলত মানের প্রশ্ন, নেতৃত্বের গুণগত উৎকর্ষের প্রশ্ন। সংখ্যায় কে কত ভোট পেল, সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জরুরি হলো—কীভাবে সেই ভোটের প্রতিফলন সংসদে ঘটছে। PR পদ্ধতিতে যখন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন দলীয় তালিকা থেকে, তখন জনগণের ভোট ব্যালট পেরিয়ে আর কণ্ঠস্বর হয়ে সংসদে পৌঁছায় না। এতে গণতন্ত্র হয় পরিসংখ্যাননির্ভর, প্রাণহীন কাঠামো। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই, যখন জনগণ সরাসরি ব্যালটে সিদ্ধান্ত নেয়—কার হাতে তুলে দেবে তাদের প্রতিনিধি হওয়ার ভার। নেতৃত্ব আসুক জনগণের রায় থেকে, কাগুজে তালিকা থেকে নয়।
আবু বকর মুহাম্মদ মুঈন উদ্দীন
সংগঠক, বাংলাদেশ গঠনতান্ত্রিক আন্দোলন
ইমেইল: [email protected]