মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানী ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় তাদের এ সাজা দেন।
এই আদেশের ফলে দেশটিতে নতুন করে ভিন্নমত দমনের মাত্রা বৃদ্ধি সম্পর্কে শঙ্কা জেগেছে বলে নিউেইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এই কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, এই আইনে মানহানিকর মনে করে এমন কিছু মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সরকারকে গ্রেপ্তার এবং বিচারের বিস্তৃত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
সরকার নির্বাচনের আগে ১৭ কোটি মানুষের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ শক্ত করে ধরে রেখেছে। ভিন্নমতের কণ্ঠকে হয়রানি ও দমন করার জন্য গত ১৪ বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব ব্যাপকভাবে দখল করেছে রেখেছে সরকার। তার মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান হলো দেশটির বিচার বিভাগ। এটি ছিল বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার জন্য সরকারের একটি বিস্তৃত প্রচারণার সর্বশেষ উদাহরণ। ক্রমবর্ধমানভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা বিচারব্যবস্থায় বিরোধীদলীয় সমর্থক, নেতাকর্মী এবং সাংবাদিকরা আটকা পড়েছেন। আদালতের কক্ষগুলো তাদের দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নেতা আদিলুর এবং এলানের বিরুদ্ধে মামলাটি এক দশক আগে একটি নৃশংস ঘটনা সম্পর্কে তাদের গ্রুপের তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে সূচনা হয়। ২০১৩ সালের ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কট্টরপন্থি ইসলামী সংগঠন আয়োজিত একটি সমাবেশ বানচাল করার জন্য পুলিশ গুরুতর নির্যাতন চালায়।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামের সংগঠনটি ওই বছরের মে মাসে মহানবী মুহাম্মদকে নিয়ে (তাদের ভাষায়) আপত্তিকর মন্তব্য ও কার্টুনের প্রতিবাদে ঢাকাকে অচল করে দেয়। তার জবাবে, পুলিশ গভীর রাতের ক্র্যাকডাউন, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং সহিংসতা চালায়।
এ ঘটনায় বিরোধী দলগুলো শত শত মানুষ নিহত হওয়ার অভিযোগ করেছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যাটি ছিল আনুমানিক ডজনখানেক থেকে ৫০ এর মধ্যে। অধিকারের প্রতিবেদনে নিহত ৬১ জনের নাম পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই, সরকার ওই দুই মানবাধিকার কর্মীকে আটক করে। এর মধ্যে আদিলুরকে ৬২ এবং এলানকে ২৫ দিনের জন্য আটকে রাখে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুসারে তাদের প্রতিবেদনকে বিকৃত এবং মানহানিকর বলে অভিহিত করা হয়। সরকারের কর্মকর্তারা জানান, অপারেশনের সময় কেউ নিহত হয়নি এবং সংসদে জানানো হয়, হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা ‘গায়ে লাল রং মেখে’ ভুয়া মৃত্যুর ঘটনা ঘটিয়েছে।
এক যৌথ চিঠিতে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ ৩০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, দুই মানবাধিকার কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টিকে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত করার প্রতিশোধ’ বলে অভিহিত করেছে। তারা মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তি চেয়েছে।
চিঠিতে সংস্থাগুলো বলছে, তহবিল পেতে বাধা দেওয়া এবং রেজিস্ট্রেশন নবায়ন না করাসহ বিভিন্নভাবে সরকার মানবাধিকার কর্মীদের এবং অধিকারকে হয়রানি করতে অব্যাহত প্রচারণা চালায়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সম্প্রতি ২০১৩ সালের মামলাটি পুনরায় চালু করা হয়। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য অধিকারের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টগুলোকে দায়ী করা হয়।
যৌথ চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘হয়রানি, ভয়ভীতি এবং প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই মানবাধিকার কর্মীদের প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে দেওয়া উচিত। যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত এবং প্রকাশ করেন, তাদের বিচার ও শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে; সরকারের উচিত (ঘটনাগুলো) তদন্ত করা এবং (মানবাধিকার) লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের জবাবদিহি করা।’
বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে অধিকারকে ‘ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণিত রেকর্ডসহ একটি অসঙ্গতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট সত্তা’ বলে অভিহিত করেছে। সরকারের ভাষ্যমতে, বিচার বিভাগ ‘প্রমাণের ভিত্তিতে এবং আইন অনুসারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে’।
এর আগে আদিলুর ও এলানের সাজা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফেডারেশনসহ বিশিষ্টজনরা বিবৃতি দিয়েছেন।